জহিরুল ইসলাম ইসহাকী
===============
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের আচার-আচরণ, নৈতিকতা এবং মানবিক গুণাবলির উপর ভিত্তি করে। ইসলামের সৌন্দর্য প্রকৃতপক্ষে ফুটে ওঠে মানুষের উত্তম আখলাক ও মানবিক গুণাবলির মাধ্যমে। মহান আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল (সা.) মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
আখলাকের সংজ্ঞা
‘আখলাক’ শব্দটি আরবি শব্দ "خُلُق" থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো চরিত্র, নৈতিকতা বা আচরণ। উত্তম আখলাক মানুষের ব্যক্তিত্বকে পরিপূর্ণতা দেয় এবং তাকে সমাজে সম্মানিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ
“আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতা দিতে প্রেরিত হয়েছি।”
(মুসনাদ আহমদ: ৮৯৫২)
আখলাক শুধু বাহ্যিক নয়, বরং অন্তরের অবস্থাকেও শুদ্ধ করে। এটি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য, মানুষের প্রতি দয়া এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম।
আল কুরআনের আলোকে আখলাক ও মানবিকতা
আল কুরআন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্রের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচার, সদাচরণ এবং নিকটাত্মীয়দের সাহায্য করার আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে বারণ করেন।”
(সুরা নাহল: ৯০)
এই আয়াতে উত্তম চরিত্র ও মানবিক গুণাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। সুবিচার, পরোপকার ও আত্মীয়স্বজনের সাহায্য মানুষের নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে আখলাকের প্রতিফলন
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাআলা তাকে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা উত্তম আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন:
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
“নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহর জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।”
(সুরা আহজাব: ২১)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
“তুমি তো মহান চরিত্রের অধিকারী।”
(সুরা কলম: ৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সদা সত্যবাদিতা, ধৈর্য, নম্রতা, দয়া, ক্ষমা, এবং মানবিক গুণাবলিতে নিজেকে অলংকৃত করেছেন।
মানবিকতার চর্চায় হাদিসের নির্দেশনা
মানবিক গুণাবলির চর্চা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ
“যারা দয়া করে, তাদের প্রতি দয়াশীল আল্লাহও দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো, আকাশের অধিপতিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।”
(তিরমিজি: ১৯২৪)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ
“সবচেয়ে উত্তম মানুষ সে, যে অন্যদের উপকারে আসে।”
(মুসনাদ আহমদ: ১২৫৫৯)
আখলাক ও মানবিকতার গুরুত্ব
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ: উত্তম চরিত্র ও মানবিক গুণাবলি অর্জন মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়।
২. সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা: উত্তম আখলাক সমাজে ন্যায়বিচার ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে।
৩. দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ: উত্তম চরিত্রের মানুষ দুনিয়াতে সম্মানিত হয় এবং আখিরাতে পুরস্কৃত হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا
“তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে সেই, যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী।”
(তিরমিজি: ২০১৮)
উপসংহার
আখলাক ও মানবিকতা ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্য। একজন মুসলমানের জীবনে আখলাকের প্রভাব এমন যে, তা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক জীবনেও পরিবর্তন আনে। উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের উচিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের চরিত্র ও মানবিকতাকে উন্নত করা।
হে আল্লাহ! আমাদের উত্তম চরিত্র ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের তৌফিক দিন। আমিন।