ডক্টর মোঃ বদরুল আলম সোহাগ
পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর আসে খুশির ঈদ—ঈদুল ফিতর। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। এই দিনে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, সাদা-কালোর সকল বিভেদ ভুলে মানুষ এক কাতারে মিলিত হয়। ঈদুল ফিতর শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার মহিমায় উদ্ভাসিত এক অনন্য অনুষ্ঠান। এই দিনে সকল মুসলমান একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে, ক্ষমা চায়, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয় এবং আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের জন্য শুকরিয়া আদায় করে।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্যঃ
‘ঈদুল ফিতর’ শব্দটি আরবি। ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ বা উৎসব, আর ‘ফিতর’ অর্থ ভঙ্গ করা। এক মাস সিয়াম পালনের পর রোজা ভঙ্গের এই দিনটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে পালিত হয়। রমজানের কঠোর সাধনার পর ঈদুল ফিতর আসে পুরস্কারস্বরূপ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—
“যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে ঈমান ও ইহতিসাব (আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা) সহকারে, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
এই দিনে মুসলমানরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এবং একে অপরের সাথে ভালোবাসা ও সম্মান বিনিময় করে।
ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতিঃ
ঈদের আনন্দ শুধু একটি দিনের নয়, এর প্রস্তুতি শুরু হয় রমজান থেকেই। ঈদের দিন সকালে গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, নতুন বা পরিষ্কার পোশাক পরা সুন্নত। ঈদের নামাজের আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক, যাতে গরীবরাও ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। নবী করিম (সা.) বলেছেন—
“রোজাদারকে ঈদুল ফিতরের দিন সদকাতুল ফিতর আদায় করে নিজের রোজাকে পবিত্র করতে হবে এবং গরীব-দুঃখীদের খাবার দিতে হবে।”(আবু দাউদ)
ঈদের দিনের আমল ও সুন্নত
১. ফজরের নামাজ আদায় – ঈদের দিন সকালে প্রথমে ফজরের নামাজ পড়ে নেওয়া।
২. গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহার – পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
৩. ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু মিষ্টি খাওয়া– সাধারণত খেজুর বা মিষ্টান্ন খাওয়া সুন্নত।
৪. পথ পরিবর্তন করে ঈদগাহে যাওয়া – এক পথে গিয়ে অন্য পথে ফিরে আসা।
৫. ঈদের নামাজ ও খুতবা শ্রবণ– এটি ঈদের অন্যতম প্রধান আমল।
৬. পরস্পর কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়– “ঈদ মুবারাক”, “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” বলা।
ঈদুল ফিতরে সাম্যের বার্তাঃ
ঈদুল ফিতরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো “সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব”। এই দিনে ধনী-গরীব, আমির-ফকির, শাসক-প্রজা সবাই একই মাঠে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। সাদা-কালো, জাতি-গোত্রের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। নবীজি (সা.) বলেছেন—
“তোমরা সবাই আদমের সন্তান, আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।” (তিরমিযী)
ঈদের দিনে গরীবদের সাহায্য করা, এতিম ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। সদকাতুল ফিতর এই সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম।
ঈদের আনন্দ: পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন
ঈদুল ফিতর পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করে। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়স্বজন একত্রিত হয়। ছোটরা বড়দের কাছে দোয়া নেয়, বড়রা ছোটদের উপহার দেয়। ঈদের বিশেষ খাবার, সেমাই, পায়েস, হালুয়া, কাবাব ইত্যাদি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে খাওয়া হয়।
সমাজের সকল স্তরের মানুষ এই দিনে একসাথে ঈদের নামাজ পড়ে, একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশল বিনিময় করে। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি “সামাজিক সংস্কৃতির” অংশ।
ঈদুল ফিতরের আধুনিক রূপ ও চ্যালেঞ্জঃ
বর্তমানে ঈদের আনন্দে কিছু বাণিজ্যিকতা ও বৈষম্য ঢুকে পড়েছে। অনেকেই ঈদের চেয়ে কেনাকাটা, ফ্যাশন ও জাঁকজমককে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ঈদের প্রকৃত শিক্ষা হলো—
– অহংকার ত্যাগ করা
– গরীবদের সাহায্য করা
– আত্মীয়তার বন্ধন মজবুত করা
– আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা
আমাদের উচিত, ঈদের প্রকৃত রূপকে ধরে রাখা এবং এর শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়ন করা।
ঈদুল ফিতর হলো আনন্দ, ক্ষমা, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মহান উৎসব। এটি আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পাশাপাশি মানবিক বন্ধনও শক্তিশালী করে। এই দিনে আমরা যেন শুধু নিজেরা আনন্দ না করি, বরং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদেরও পাশে দাঁড়াই।
“ঈদ মুবারাক!”
“তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম!”
(আল্লাহ আমাদের ও আপনার ইবাদাত কবুল করুন!)