লেখকঃ জহিরুল ইসলাম ইসহাকী
====================
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীনচেতা, ন্যায়ের পূজারি এবং সত্যের অনুসারী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, যখন কোনো সমাজে অবিচার, দুর্নীতি, স্বৈরাচার ও অন্ধকারের আধিপত্য বিস্তার করে, তখন মানবতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অসততা যখন নীতিতে পরিণত হয়, ক্ষমতা যখন দুঃশাসনের হাতিয়ার হয়, তখন সেই সময়কে আমরা কলুষিত অধ্যায় বলে অভিহিত করি।
আজকের সমাজ, আজকের রাষ্ট্র—সবকিছু যেন এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন, ন্যায়বিচার ধূলিসাৎ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এমন এক কলুষিত অধ্যায়ে বাস করছি আমরা, যেখানে সত্য বলা অপরাধ, প্রতিবাদ করা বিপজ্জনক, আর ন্যায়বিচারের দাবি করা হাস্যকর! কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা বলে—অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়। সূর্য যেমন পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়ে রাতের অন্ধকারকে দূর করে, তেমনি সত্য, ন্যায় ও নৈতিকতাও একদিন এই কলুষিত অধ্যায়ের অবসান ঘটাবে।
এক কলুষিত সময়: ন্যায়বিচারের অপলাপ
একটি সমাজ তখনই কলুষিত হয়, যখন সেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। আজ আমরা এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে অপরাধীদের বিচার হয় না, দুর্নীতিবাজরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে, এবং সৎ ও যোগ্য মানুষেরা পদে পদে লাঞ্ছিত হয়।
আইনের শাসনের পরিবর্তে ক্ষমতার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সত্যের পরিবর্তে মিথ্যার জয়গান চলছে।
নৈতিকতার পরিবর্তে চাটুকারিতা ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই কলুষিত সমাজে সাধারন জনগণের কোনো মূল্য নেই, সত্যভাষীদের স্থান কারাগারে, প্রতিবাদীদের গুম-খুন করা হয়, আর যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায়, তারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়।
এক কলুষিত সমাজ: যেখানে বিবেক বিক্রি হয়
আজকের সমাজ এমন এক জঞ্জালে পরিণত হয়েছে, যেখানে সত্যকে বিকৃত করা হয়, সত্যবাদীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়, এবং মিথ্যার জয়জয়কার চলে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থে আইনকে খেলনার মতো ব্যবহার করে, আর সাধারণ জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নেই, সত্য লিখলেই মামলা-মোকদ্দমা!
শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস, যেখানে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি হয়।
স্বাস্থ্যসেবা দুর্নীতির কবলে, যেখানে রোগী চিকিৎসার পরিবর্তে হয়রানির শিকার হয়।
প্রশাসনে স্বজনপ্রীতি, যেখানে যোগ্যতার পরিবর্তে ঘুষই চাকরির মাপকাঠি।
এই সমাজে নৈতিকতা যেন বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ, বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। প্রতিদিন আমরা দেখি দুর্নীতির নতুন নতুন কৌশল, অত্যাচারের ভয়াবহ রূপ, ক্ষমতার অপব্যবহার। এই কলুষিত অধ্যায় কি চিরকাল চলবে? না, নিশ্চয়ই একদিন এর অবসান ঘটবে!
যুগে যুগে কলুষিত অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে
ইতিহাস সাক্ষী, যখনই সমাজে অবিচার ও অন্ধকার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনই পরিবর্তনের জোয়ার উঠেছে। যুগে যুগে সত্য ও ন্যায়ের সৈনিকেরা কলুষিত সমাজকে ধ্বংস করেছে, নতুন আলোর দ্বার উন্মোচন করেছে।
(১) নবী-রাসুলদের সংগ্রাম
হজরত মূসা (আ.) ফিরআউনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ ফিরআউনের রাজত্ব ছিল কলুষিত। হজরত মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করে গেছেন, সত্যের আলো কখনো নিভে না।
(২) মুসলিম বীরদের লড়াই
সালাহউদ্দিন আইউবি, সুলতান মাহমুদ গজনভি, টিপু সুলতান—তাঁরা সকলেই একসময় কলুষিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন।
(৩) বাংলার মাটিতে মুক্তির সংগ্রাম
বাংলাদেশের ইতিহাসও সাক্ষী, কখনো কখনো সমাজের কলুষিত অধ্যায় ধ্বংস হয়েছে। ব্রিটিশদের শোষণ, পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার, স্বৈরাচারী শাসকদের দুঃশাসন—সবকিছুরই একসময় অবসান ঘটেছে।
তবে আজও আমরা এক ভয়াবহ সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে সত্য বলার স্বাধীনতা নেই, ন্যায়বিচার ধূলিসাৎ, এবং ক্ষমতার দম্ভে দুর্নীতির নৃত্য চলছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, পরিবর্তন আসবেই।
আমাদের করণীয়: সত্যের সৈনিক হতে হবে
একটি কলুষিত অধ্যায়ের অবসান কোনো জাদুর কাঠির স্পর্শে ঘটবে না। বরং ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদী মানুষদের সংগ্রামের মাধ্যমেই এটি সম্ভব হবে। আমাদের করতে হবে—
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় থাকতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
জাতির বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।
শিক্ষিত ও সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তারা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে। যারা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দেয়, তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে।
নতুন দিনের অপেক্ষা
এই কলুষিত অধ্যায়ের অবসান চাই। আমরা এমন এক সমাজ চাই, যেখানে সত্যের জয় হবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে, এবং জনগণ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে।
অন্ধকার রাত যতই গভীর হোক, সূর্যের আলো একসময় উদিত হবেই। মিথ্যার শক্তি যতই প্রবল হোক, সত্য একদিন বিজয়ী হবেই। ইতিহাসের এই চক্র কখনো ব্যতিক্রম হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তাই আসুন, আমরা সত্য, ন্যায় ও আলোর পথে থাকি। কারণ, পরিবর্তন হবেই—”একটি কলুষিত অধ্যায়ের অবসান হবেই!”