জহিরুল ইসলাম ইসহাকী
===============
পদ্মা নদী—এক জীবন্ত কবিতা, যেখানে জল আর আকাশ মিলে এক চিরন্তন রূপকথার সৃষ্টি করে। এই নদী কেবল জলপ্রবাহ নয়; এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর প্রকৃতির এক অপরূপ রূপময়তার প্রতীক। জীবনের প্রথমবার পদ্মার তীরে পা রাখার অভিজ্ঞতা এমনই এক অনন্য অনুভূতি, যা শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। তবু সাহিত্যের ভাষায় তার গভীরতাকে স্পর্শ করার একটি চেষ্টা করা যেতেই পারে।
প্রথম পদ্মা দর্শন: মুগ্ধতার সূচনা
আমি যখন জীবনের প্রথমবার পদ্মার তীরে দাঁড়ালাম, তখন সেদিনের সূর্য যেন পৃথিবীকে নতুন রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল। আকাশজুড়ে লাল-সোনালি আভা, আর নদীর পানিতে তার প্রতিফলন—মনে হচ্ছিল যেন ক্যানভাসে আঁকা কোনো চিত্রকর্ম। পদ্মার বিশালতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। মনে হচ্ছিল, এটি একটি শান্ত অথচ প্রবল আত্মার প্রতিচ্ছবি, যা তার নিজস্ব গতিতে চলমান।
নদীর জলের নড়াচড়া আর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ যেন এক মরমি সুর তৈরি করছিল। বাতাসে ভেসে আসা কাদামাটির গন্ধ আমাকে শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। আমি প্রথমবার বুঝতে পারলাম, নদী শুধু প্রকৃতির অংশ নয়; এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
পদ্মার সঙ্গে অনুভূতির সংযোগ:
নদীর তীরে বসে আমি বুঝতে পারলাম, পদ্মা কতটা রহস্যময়। এর স্রোত যেন আমাকে বলছিল, "জীবনও এভাবেই প্রবাহমান। কখনো ধীর, কখনো উত্তাল।" আমি পদ্মার ঢেউ দেখে জীবনের ওঠানামার কথা ভাবছিলাম। নদী যেমন আপন বুকে সমস্ত কিছু ধারণ করে, তেমনি আমাদের জীবনও সুখ-দুঃখের নানা অনুভূতি ধারণ করে।
সেদিন আমি অনুভব করলাম, পদ্মার মতো মানুষকেও উদার হতে হয়। এই নদী যেভাবে তার তীরে থাকা গ্রামবাসীকে খাদ্য, পানীয়, আর জীবিকার উৎস দেয়, আমরাও তেমনভাবে অন্যদের কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করতে পারি।
স্মৃতির খেলা: পদ্মার মানুষ ও জীবন
পদ্মার তীরে বসে আমি স্থানীয় মানুষের মুখে পদ্মার গল্প শুনছিলাম। কেউ বলছিলেন, "পদ্মা আমাদের মা।" কেউবা স্মৃতিচারণ করছিলেন পদ্মার ভাঙনের। নদী যেমন একদিকে জীবন দেয়, অন্যদিকে তা কখনো কখনো কেড়ে নেয়। তবুও মানুষের নদীর প্রতি ভালোবাসা যেন কখনো কমে না।
এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছিলেন, "বাবা, পদ্মা বড় বিচিত্র। এ নদী যেমন বাঁচায়, তেমনি শিখিয়ে দেয় সহ্যশক্তি। এর স্রোত আমাকে শেখায়, জীবন কখনো থেমে থাকে না।"
পদ্মার সন্ধ্যাকাল: প্রকৃতির এক চিত্রকল্প
সন্ধ্যা নেমে এলে পদ্মার সৌন্দর্য যেন আরো গাঢ় হয়ে উঠল। নদীর বুকে জেগে উঠল জোনাকির আলো, আর দূরের গ্রামের কুপি বাতির স্নিগ্ধ আভা। নৌকার মাঝি তখন সুরে সুরে গাইছিলেন ভাটিয়ালি গান। গানের প্রতিটি শব্দ যেন পদ্মার স্রোতের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই নদী শুধু জল নয়, এটি মানুষের সংস্কৃতি ও আবেগের ধারক।
পদ্মার শিক্ষা:
জীবনের প্রথম পদ্মা দর্শন আমাকে শিখিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে কীভাবে সম্প্রীতি স্থাপন করতে হয়। এই নদী যেমন নিজের সবকিছু বিলিয়ে দেয়, তেমনি আমাদেরও নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, এবং ভালোবাসা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
উপসংহার:
পদ্মার তীরে কাটানো সেই প্রথম মুহূর্তগুলো আমার জীবনে এক বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি আজও অনুভব করি সেই নদীর স্নিগ্ধ বাতাস, শুনতে পাই ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, আর দেখতে পাই জলরাশির অপার সৌন্দর্য। পদ্মার বুকে যে জীবনের প্রতিচ্ছবি আমি দেখেছি, তা আমাকে আজও নতুন করে বাঁচতে শেখায়। পদ্মা যেন এক জীবন্ত কবিতা, যার প্রতিটি শব্দ হৃদয়ের গভীরে থেকে যায় চিরকাল।