শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

প্রতিভাবান এক পুরুষ “সুনির্মল দাস বাপী”

Coder Boss
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ৪ Time View

কলমেঃ চিত্রশিল্পী মিলন বিশ্বাস

 

শত প্রকার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সুন্দরভাবে বহিঃপ্রকাশ করে বাদ্যযন্ত্রের তালে সেই বাদ্যযন্ত্রের রূপ দিয়ে জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে সুনাম অর্জন করেছেন সুনির্মল দাস বাপী, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও বাংলাদেশের কালচার কে হৃদয়ে ধারণ করে তৈরি করলেন একের পর এক ধারাবাহিকভাবে বাদ্যযন্ত্র। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার গান্ধিয়াশুর গ্রামে ১৯৯৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি একটু দুর্বলতা কাজ করতো। যেখানেই বাদ্যযন্ত্র পেতেন সেখানেই তিনি পৌঁছে যেতেন ।পিতা স্কুলশিক্ষক সুনীল কুমার দাস এর কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

তিনি গান-বাজনায় ছিলেন পারদর্শী। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে সংগীতচর্চার পরিবেশ পেয়েছেন। তিনি বাবার কাছ থেকে শেখেন একতারা বাজানো। কাকার কাছ থেকে ঢাক বাজানো। প্রতিবেশী বর্ষীয়ান কারুশিল্পী বিজয় পাণ্ডের কাছ থেকে প্রথমে দোতারা, বেহালাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা শেখেন। কিশোর বয়স থেকেই সুনির্মল সামনে যা পান, তা দিয়েই সুরের খেলায় মেতে ওঠেন। বানাতে থাকেন একের পর এক নিত্যনতুন বাদ্যযন্ত্র। গুনী বাদ্য করের তথ্য সংরক্ষণে চিত্রশিল্পী মিলন বিশ্বাস ।

 

তিনি কিশোর বয়সে বাবা-কাকার হাত ধরে ছুটে যেতেন পালাগান, কবিগান, হরিসভা কীর্তন, বাউল-ভাটিয়ালির আসরে। ছুঁয়ে দেখতেন বাদ্যের শরীর।একবার এলাকায় এক মহোৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে শিল্পীরা এসেছেন। কিশোর ছেলেটির নজর পড়ল বাউলের একতারায়। আনাড়ি হাতের আঁচড়ে একতারার তার গেল ছিঁড়ে। বাউল বেশ বিরক্ত হলেন ছেলেটির ওপর। ছেলের এমন কাণ্ডে বাবাও বিব্রত। কিছুদিন পর একটি একতারা কিনে নিয়ে এলেন বাড়িতে। ছেলেকে বললেন, ‘দেখ বাজে কিনা?’ হাত ধরে শিখিয়ে দিলেন। সেই থেকে শুরু। তারপর হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তাতেই ওঠে সুর-তাল। খেলনা কিংবা ফেলনা, সবেতেই কেবল সুর খোঁজা। বাদ্যের সে ভান্ডারে কখনও যোগ হয়েছে ঘটি-বাটি, কখনও নারকেলের মালা। কখনও বুনো বাঁশ কোকিলের কণ্ঠ নিয়ে বাজছে নির্ভুল। কখনও আবার সুর উঠেছে শামুক-ঝিনুকে। এই গুনি শিল্পীরা ৪ ভাই-বোনের মধ্যে সুনির্মল দাস বাপী সবার ছোট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথড় ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরত। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নারকেলের মালা দিয়েও যে একতারা তৈরি করা যায়, তা দেখে অনেকটা অবাক হন সুনির্মল। পরে বিভিন্ন লোকবাদ্য তৈরি ও বাজানোর তালিম নেন। বাসু বালার কাছ থেকে বেহালা, গোপাল শর্মার কাছ থেকে খমক, নিরঞ্জন ওস্তাদের কাছ থেকে সরোদ, অমিতোষ বিশ্বাস ও ভবানী শংকর বিশ্বাসের কাছ থেকে তবলা বাজানোর হাতেখড়ি নেন।

সুনির্মল দাসের তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– একতারা, দোতারা, সারিন্দা, খমক খঞ্জনি, কাঠসেকার, চুড়িসেকার, মনসেকার, পাখিবাঁশি, বাঁশের বাঁশি, সরোদ, বেহালা, কাহন, ঢাক-ঢোল, তবলা, গোপীযন্ত্র, জলতরঙ্গ, কোকিলের ডাক, সানাই, প্রেমজুড়ি, রাবনবীণা, পাখওয়াজ, নাল, ডুগডুগি; বাঁশ থেকে তৈরি ফুরাংফাং, চটা, মোহনবাঁশি; নারকেলের মালা থেকে একতারা, ম্যাচবক্স, বীণ, মেরাকাচ, শিঙা, কাঠের ঘণ্টা, অ্যাম্বুলেন্স বাঁশি প্রভৃতি। এর প্রতিটি যন্ত্র বাঁজাতেও পারেন।নিজের খেয়ালে টিউন করেন। বললেন, ‘বাজারে প্রচলিত একতারা তো টেনটেন করে। আমারটার সুর অনেক ভরাট, ‘আমি যেখানে যাই, সেখানেই বাজানোর জন্য নতুন কিছু পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করি। তেমন কিছু পেলে সংগ্রহ করি। হাতের কাছের জিনিস নিয়ে সুর-তালের খেলা করি। নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও প্রশ্রয় দেয় খুব।

কেউ একটা নারকেলের মালা অথবা লাউয়ের খোল পেলেও রেখে দেয় আমার জন্য। জানার আগ্রহ হলো ব্যতিক্রমী পাখিবাঁশিটি নিয়ে। বাপী জানালেন, একবার তিনি বইমেলায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক লোক সিরামিকের বাঁশি বিক্রি করছেন। পানি ভরে ফুঁ দিলে পাখির ডাকের মতো শব্দ হয়। ১০০ টাকা দিয়ে কিনলেন বাঁশিটি। বাজে চমৎকার। হাত থেকে পড়লে তো ভেঙে যাবে, আবার দামও বেশি। ভাবলেন এমন বাঁশি নিজে বানানো যায় কিনা। যেই ভাবনা, সেই কাজ। হাতের কাছে আছে একটি নাকের ড্রপ আর ললিপপ চকলেটের পাইপ। খানিকক্ষণ চেষ্টায় হয়ে গেল শিসবাঁশি। পানি ভরে ফুঁ দিলে পাখির ডাকই শোনা যায়।প্রতিবেশী অমূল্য দাদুর কাছে দেখেন শামুকযন্ত্র। তিনি সুর তুলছিলেন যন্ত্রটি দিয়ে। দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথা থেকে পেয়েছেন?’ তিনি বললেন, ‘এটি আমি ছোটবেলা থেকে নিজেই শিখেছি।’ তারপর তাঁর কাছ থেকে শিখলেন শামুক দিয়ে বাদ্য তৈরি। সুর তোলা যায় ম্যাচ বাক্সেও। এটা জানতে পেরে ম্যাচ বাক্স বা দেশলাই দিয়ে বাজানোর চেষ্টা করেন বাপী। স্থানীয় শহীদ মিয়া ও পরিতোষ বিশ্বাসের কাছ থেকে শিখেছেন এ যন্ত্রে সুর তোলার পদ্ধতি।এভাবেই বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়েছে সুনির্মলের সুনিপুণ হাতে। তাঁর ছোট ঘরটি যেন লোকবাদ্যের এক বিরল সংগ্রহশালা। সব জায়গায়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বাদ্যযন্ত্র এবং তা তৈরির উপকরণ। সুনির্মল একসময় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। কখনও অভিনয় করে লোক হাসিয়ে উপার্জন করতেন। সেই টাকা জমিয়ে বাদ্য বানাতেন। আমি যখন প্রশ্ন করি এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে যে অর্থ প্রয়োজন হয়েছে আপনি কোথা থেকে এই অর্থের যোগান পেয়েছেন তখন এ বিষয়ে তুলে ধরেন সুনির্মল দাস বাপী”

এখন অবশ্য রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে। তবে যৌথ পরিবারে অভাব তো আর পিছু ছাড়ে না। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাদ্য বিক্রি হয়। তাতে খুব লাভ হয় না।নিজের তৈরি এসব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন একাধিকবার। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচী সম্মেলনে প্রদর্শনী করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। একই বছর গোপালগঞ্জেও লোকজ বাদ্য প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন জায়গায় বাদ্য প্রদর্শনীতে অংশ নেন। প্রদর্শনীর পাশাপাশি এসব বাদ্য বাজিয়েও মানুষকে শোনান তিনি। বিলম্বিত বিরহ নামক একটি নাটকে খমক বাজিয়ে অভিনয়ও করেছেন। ভবিষ্যতে সাহায্য-সহযোগিতা পেলে নিজ বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার আশা ব্যক্ত করেন সুনির্মল দাস বাপী। হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের সুর শোনাতে চান নতুন করে। এসবের মধ্য দিয়ে যেন জোড়া লাগাতে চান শৈশবে ছিঁড়ে ফেলা বাউলের একতারাটি।

 

লেখক পরিচিতি চিত্রশিল্পী মিলন বিশ্বাস।

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

খুলনা আর্ট একাডেমি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102