কলমে: খন্দকার মাসুম মুক্তাদীর।
শীতের সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে শরিফুল দাঁড়িয়ে থাকে মগবাজারের মোড়ে। ট্রাফিক জ্যামের ভেতর দিয়ে একটা বাসা খুঁজে বেড়ায় মন। বাসা মানে, শান্তি। কিন্তু সেই শান্তি আজকাল শরিফুলের জীবনে যেন মেঘের ভেলার আলো ছায়ার মতো এই আছে, আবার নেই।
পকেটে গোনা টাকা, হাতে বাজারের লিস্ট। লিস্টটা দেখে শরিফুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ডিম, পেঁয়াজ, তেল, আলু—সাধারণের চেয়ে সাধারণ জিনিস। অথচ লিজার মুখে আজ সকালে শুনেছে, “বাজারে একটা বড় ইলিশ এনো। রুনিরা আসছে।”
ইলিশ? শরিফুল হেসেছিল, কেমন যেন বিষণ্ণ হাসি। মাসের শেষ, পকেটে মাত্র হাজার দুয়েক টাকা। ইলিশের দাম হাজারে হাজার। কিন্তু হাসিটা লুকিয়ে লিজাকে বলেছিল, “দেখি কী করা যায়।”
মনে পড়ে, বিয়ের পর প্রথমবার লিজার মুখে সেই খুশি দেখেছিল। তখন ছোটো মাছের এক পাতিলে রুনির কী আনন্দ! এখন বড় ইলিশও সেই আনন্দ ফিরিয়ে আনে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ হয়।
বাজারে মাছের দোকানে দাঁড়িয়ে শরিফুল বড় ইলিশগুলোর দিকে তাকায়। দোকানদার হাসিমুখে বলে, “ভাই, বড় সাইজ। কেজি তিন হাজার। নিবেন?”
শরিফুল শুকনো গলায় বলে, “ছোট দেখান।” দোকানদার বলে, “নাই ভাই।”
ডিম আর পেঁয়াজ কিনে শরিফুল বাসায় ফেরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তার মনে হয়, প্রতিদিন এই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জীবন যেন একটা গোলকধাঁধা হয়ে গেছে। উপরে ওঠা মানে সমাধান নয়, বরং আরও জটিলতা।
দরজা খুলতেই লিজার মুখের সেই হাসি। কিন্তু শরিফুল জানে, এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা চাপা ক্ষোভ।
“সব এনেছো?” লিজার সরল প্রশ্ন।
“ইলিশ আনিনি,” শরিফুল মাথা নিচু করে বলে। “ডিম আর পেঁয়াজ এনেছি। ডিমের দোপেঁয়াজা করো।”
লিজার মুখ শক্ত হয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে, “তোমার কি কোনো অনুভূতি নেই? বোন আসছে, সামান্য একটা মাছ, তাও আনতে পারলে না?”
শরিফুল ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে। “ইলিশের দাম জানো? মাসের শেষে পকেট একদম খালি। সংসার চালাই কীভাবে, সেটা কখনো ভাবো?”
রুনি মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। তার পায়ের আওয়াজে যেন চাপা অভিমানের ঝংকার।
রাতে খেতে বসে শরিফুল টের পায়, ডিমের দোপেঁয়াজা রান্না হলেও তাতে স্বাদ নেই। খাবারের চেয়ে চারপাশের নীরবতা আরও ভারি। সে চুপচাপ খায়, আর ভাবে “এই সম্পর্ক কি এমনই থাকবে?”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরিফুল রাস্তায় তাকায়। জীবনের পথ যেন সেই রাস্তাগুলোর মত কত বাঁক নেয়, জটিল, আর অনিশ্চিত। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পরদিন সকালে শরিফুল কিছু টাকা কর্জ করে একটা বড় ইলিশ নিয়ে বাসায় ফেরে। লিজার চোখে আনন্দের ঝিলিক। তার কণ্ঠে চাপা বিস্ময়, “তুমি আনলে?”
“তোমার জন্য,” শরিফুল কেবল এটুকুই বলে।
লিজার মুখে হাসি ফেরে। কিন্তু শরিফুল জানে, এটা ক্ষণস্থায়ী। ইলিশ শেষ হবে, আবার কোনো নতুন চাহিদা উঠে আসবে। এটাই জীবন।
নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় শরিফুল। নিজেকে দেখে। চেহারায় ক্লান্তি, চোখে দুশ্চিন্তা। সে ভাবে, এই সংসার কি শুধু চাহিদা আর পূরণের চক্র? সম্পর্কের মাধুর্য কি হারিয়ে গেছে?
কিন্তু তখনই বারান্দা থেকে ভেসে আসে লিজার গলায় গান। একটা পুরোনো গান, যে গান শুনে শরিফুল একদিন তাকে ভালোবেসেছিল।
হয়তো এখানেই জীবনের সৌন্দর্য। চাহিদা আর ত্যাগের মাঝেও কিছু ভালোবাসা থেকে যায়। শরিফুল মনে মনে বলে, “এই পথই আমাদের। যতই কঠিন হোক, চলতে হবে একসাথে। আলো এখানেই।”
আর নিজের অজান্তেই আবৃত্তি করে ওঠে শরিফুল-
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই;
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
ভালোবাসার নবরূপ উদয়ের পথে শরিফুল ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। এভাবেই একদিন পৌঁছে যাবে…..।