কলমে: সুফিয়া ডেইজি
মা ছাগলের তিনটা বাচ্চা। বয়স একদিন। সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা গুলো দেখতে আশেপাশের বাচ্চারা আসছে।বাড়ির মালিক আদর করে নাম রাখলো ধলু,কালু আর ডোরা।একটা কুকুর তাদের পাশেই থাকে। প্রায়ই মা ছাগলের সাথে বসে গল্প করে বলে বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছে। বাড়ির মালিক কুকুরকে ট্যাটনা বলে ডাকে।কুকুর ছাগলের তিনটি বাচ্চা দেখে মহাখুশি তাই তাদের সাথে গল্প করতে শুরু করে দিলো।কুকুর বলছে জানো এখানে অনেক সুন্দর সবুজ ঘাস আর অনেক রকম ফসলের মাঠ আছে।তোমাদের আর কয়দিন বয়স বাড়ুক আমি নিয়ে যাবো। দেখবে এই গ্রাম টা কত সুন্দর! আর সবাই তোমাদের কত আদর করছে।তিন ছাগলের বাচ্চা কুকুরের আদর পেয়ে কুকুরকে মামা মামা বলে সারাক্ষণ বিভিন্ন প্রশ্ন করছে।যখন যা দেখছে তখনই বলছে ব্যাব্যা এটা কি? কুকুরের পায়ের কাছে গিয়ে লাফালাফি করছে।কুকুর ঘেউঘেউ করছে আর বাচ্চা তিনটা আরও এঁকেবেঁকে লাফ দিচ্ছে আর গান গাইছে ব্যাব্যা।কিছুদিন পরে
কুকুরের সাথে তিন বাচ্চা মাঠে বেড়াতে গেলো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে তবুও ঘরে আসছেনা দেখে মা ছাগল খুঁজতে সেই মাঠে গেলো ।কুকুর আর দুটো বাচ্চা তারা মা ছাগলের কাছে এসে ঘেউঘেউ ভ্যাভ্যা করে বললো,ধলুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। মা ছাগল তাদের সাথে নিয়ে অনেক খুঁজে অবশেষে পাশের জঙ্গলে গিয়ে কান্নার শব্দ পেলো।দৌঁড় দিয়ে গিয়ে দেখে এক শেয়াল তাকে ভয় দেখাচ্ছে। এমন সময় ট্যাটনা শেয়ালের সাথে লড়াই করে ধলুকে শেয়ালের মুখ থেকে ছাড়িয়ে আনলো।মা ছাগল ধলুকে বুকে টেনে নিলো।তারপর দ্রুত সবাই কে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিলো। এমন সময় পথের মধ্যে দেখলো একটা কালো ছায়ার মতো দৈত্য হুংকার দিয়ে বলছে জুবুথুবু খামু।তখন মা ছাগলসহ তিন বাচ্চা ভয় পেয়ে গেলো।কুকুর ঘেউঘেউ করে বললো কোনো ভয় নেই তোমরা আমার সাথে এসো।এরা শুধু ভয় দেখায় আর কিছুই করতে পারে না। অনেক ভয়ে ভয়ে মা ছাগল ছাগলছানাগুলোর সাথে গল্প করতে করতে সেই জংগল থেকে বের হয়ে মাঠে এসে পৌঁছালো। মা পিছনে ফিরে দেখে ধলু কালু আছে কিন্তু ডোরা নেই।মা ছাগল ধলু আর কালু কে বললো,তোমরা চুপ করে এখানে বসে থাকবে কোথাও যাবেনা। আমি ডোরাকে খুঁজে নিয়ে আসছি।এই বলে মা ছাগল আবারও পিছন দিকে যাচ্ছে আর ভাবছে ট্যাটনা কে বিশ্বাস করে তার সাথে ডোরা কে রাখলাম আর কুকুর কোনো বেইমানি করলো নাতো?মা ছাগলের এইসব ভেবে ভীষণ কান্না পাচ্ছে।জংগলের ধারে আসতেই দেখতে পেলো ডোরা ব্যাব্যা করে কাঁদছে আর ট্যাটনা কুকুর তাকে ঘেউঘেউ করে আদরের সুরে বলছে ভয় পেওনা।আমি ঠিক তোমায় তুলে নিয়ে আসবো তুমি শুধু আমার পা ধরো।মা ছাগলের মনে রাগ হলো। কিন্তু কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতে পায় ডোরা একটা ছোট গর্তে পড়ে গিয়েছে আর ট্যাটনা তাকে উঠানোর চেষ্টা করছে এই ঘটনা দেখে মা ছাগলের ট্যাটনার প্রতি আরও বিশ্বাস বেড়ে গেলো। ডোরা মাকে দেখে শান্তির সুরে ব্যাব্যা করতে শুরু করলো। কুকুর আর মা দুজনেই ডোরাকে উপরে উঠিয়ে আনলো।দ্রুত পায়ে মা, ডোরা আর কুকুর মাঠে ছুটে এলো। এদিকে এসে দেখে যে সেই দৈত্য এসে ধলু আর কালুর গলা চিপে ধরেছে।আর উচ্চস্বরে বলছে এবার তোদের কে বাঁচাবে? এমন সময় কুকুর ঘেউঘেউ করতে করতে দৈত্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর মা ছাগলকে বললো তুমি বাচ্চাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও আমি দৈত্যকে দেখছি।অনেক ধসতাধসতির পরে দৈত্য হার মেনে পালিয়ে যায়। বাড়িতে ফিরে ছাগলছানা গুলো ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।মা ছাগল কুকুরের অপেক্ষা করছে।অবশেষে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে কুকুর এসে পাশে বসলো।মা ছাগল দেখে বুঝতে পেরেছে যে কুকুর ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। তখন কিছু খাবার ট্যাটনাকে এগিয়ে দিলো। কুকুর খাবার খেতে খেতে মা ছাগলকে বললো ,কালু ধলু আর ডোরাকে ভালো করে দেখে রেখো। তিন ছাগলছানা কুকুরের পিঠে চড়ে খেলা করতে শুরু করলো। আর কুকুর তাদের সাথে মহাখুশিতে দিন কাটাতে লাগলো। এক বছর পরে একদিন হঠাৎ করে ডোরাকে বাড়ির মালিক বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাবে বলে সবার সাথে আলোচনা করছে।এ কথা শুনে ধলু আর কালু মা ছাগলকে বললো,মা তুমি ডোরাকে বাঁচাও।মা শুনে ভ্যাভ্যা করে কাঁদতে লাগলো আর তিন সন্তান কে মুখের কাছে নিয়ে আদর করতে লাগলো। ডোরা ব্যাব্যা ভ্যাভ্যা করে কুকুর কে জিজ্ঞেস করলো বিক্রি করবে আমায় শুনে সবাই কাঁদছে, বিক্রি কি?কুকুর বললো,ঘেউঘেউ বিক্রি মানে অন্য কোথাও দিয়ে দিবে।শুনে ডোরা কুকুরের কাছে বায়না ধরলো ব্যাব্যা মামা আমি যাবো না। কুকুর ডোরাকে নিয়ে মা ছাগলের কাছে এলো। এবং সবাই মিলে মালিকের গায়ের কাছে ভ্যাভ্যা! ব্যাব্যা!ঘেউঘেউ! করে আবদার করতে লাগলো। মালিক শুধু সবার গা নেড়ে আদর করে দিয়ে বললো,কি করবো বল? আমার যে খুব টাকার দরকার। পরের দিন সকালে খাইয়ে ডোরাকে পাড়ার অন্য একজনের হাতে তুলে দিলো।ডোরা অনেক কাঁদলো ভ্যাভ্যা! ভ্যাভ্যা! মা,ধলু,কালু,ট্যাটনা সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলো আর নীরবে চোখের জল ফেললো। অনেক দিন পরের কথা চারিদিকে ঘরে ঘরে নতুন নতুন গরু ছাগল কিনে আনছে সবাই। প্রত্যেক বাড়ি থেকে ছাগলের আর্তনাদ ভেসে আসছে ভ্যাভ্যা।দিনের চেয়ে রাত কাটানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। রাতে প্রত্যেক বাড়ির ছাগল ভ্যাভ্যা করে চিৎকারে সবার ঘুম নষ্ট করে দিচ্ছে।সাথে বুক ভাঙ্গা বেদনা।কুকুর মামা আর মা ছাগলের মন খুব খারাপ। চুপচাপ বসে থাকে। ধলু আর কালু গল্প করছে কি হয়েছে রে? মা আর কুকুর মামা এতো কাঁদছে কেনো? কেনো তাদের মন খারাপ? পাশের বাড়ির নতুন কিনে আনা ছাগল বললো, মানুষরা আমাদের ঈদের দিন কেটে গোস্ত বানিয়ে খাবে।আমরা আর এই দুনিয়ার কোনো কিছু দেখতে পাবো না।শুধু কি তাই আমাদের গলা কেটে তারপর টুকরো টুকরো করবে।আর মানুষ মজা করে খাবে! এই কথা শুনে কালু আর ধলু ভয় পেয়ে গেলো ।তারা মা ছাগল আর কুকুর মামার কাছে আবদার করলো ভ্যাভ্যা! ভ্যাভ্যা! আমরা গোস্ত হতে চাইনা।শুনে কুকুর নিচের দিকে মুখ করে চুপ হয়ে রইলো। আর মা ছাগল দুই কাঁধে দুজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকলো। আজ কয়দিন খুব আদর যত্ন করে বেশি বেশি খেতে দিচ্ছে বাড়ির সবাই কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। কালু বলল,ভ্যাভ্যা! শোনো ভাই এভাবেই আমাদের অন্যের সুখের জন্য শেষ হতে হয়।তাই এসব ভেবে আর মনের কষ্ট বাড়িও না।আজ পাড়ার সবাই আদর করে গোসল করিয়ে, খাইয়ে যার যার ছাগল নিজের বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলো।শুনতে পেলুম।জবাই দিবে।আজ নাকি তাদের ঈদ।কালু আর ধলুকেউ গোসল করিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।তারা খুব কাঁদছে। মা সহ্য করতে পারছেনা। কুকুর বললো,শোনো চিন্তা করো না। তোমাদের জবাই দেয়া হবে আল্লাহর নামে।কিন্তু মানুষ আর আমাদের ও একদিন এই দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে মৃত্যুর পথে। তোমাদের মা কেউ গোস্ত বানাবে একদিন এখন তোমার মায়ের পেটে ছাগল ছানা আছে তাই এবার বেঁচে গেলো।এমন সময় ঈদ মোবারক! বলে হুজুর এসে দাঁড়ালো।তারপর প্রথম কালুকে ধলুর চোখের সামনে বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর বলে গলা কেটে দিলো। কালু অনেক চিৎকার করলো ভ্যাভ্যা কিন্তু কেউ শুনলো না। এবার ধলুকে নিয়ে গেলো। ধলু ও ভ্যাভ্যা! করে মাকে বললো, বাঁচাও বাঁচাও!মা ছাগল সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলো।ট্যাটনা শুধু মানুষের কাছে গিয়ে ঘেউঘেউ করে ফরিয়াদ করছে ধলু আর কালুকে ছেড়ে দেয়ার জন্য কিন্তু কেউ শুনলো না। চারিদিকে মানুষের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কত আনন্দ করছে,সবাই মজা করে গোস্ত ভাত খাচ্ছে আর আমার বুক ছিড়ে শুধু কান্না আসছে মা ছাগল মনে মনে এসব বলছে আর কাঁদছে।ঘরে ঘরে রান্না হচ্ছে, গ্রামের অনেক কুকুর দলে দলে ভাগ হয়েছে হাড় মাংস খাবে বলে। এদিকে ট্যাটনা সে দলে না যোগ দিয়ে বাড়ির পেছনের খড়ের গাদায় শুয়ে কাঁদতে লাগলো৷ দিন গড়িয়ে বিকেল হলো চারিদিকে গোস্ত ভাতের সুগন্ধ নাকে পেয়ে সহ্য করতে না পেরে
ট্যাটনা অন্য বাড়ি গেলো ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ করতে করতে তবুও ধলু আর কালুর হাড় মাংস খাওয়ার কথা ভাবতেই পারলো না।