বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:০৫ পূর্বাহ্ন

গল্পঃ নির্মম ভাইফোঁটা

Coder Boss
  • Update Time : সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৩ Time View

কলমেঃ কাকলি বিশ্বাস।

সুবীর ব্যাংকে চাকরি করে আর ওর স্ত্রী কঙ্কনা একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। ওদের সংসারের এদের একমাত্র পুত্র সোনু আর ওদের ৭০ বছরের বাবা আছেন , আর মা প্রায় সাত বছর আগে ওদের বাবা শুভদীপকে ছেড়ে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। ওদের বাবা শুভদীপ বাবু স্ত্রী মারা যাওয়া পর থেকে বড্ড একা হয়ে গেছেন। তিনি পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন , অবসর নিয়েছেন তাও প্রায় বারো বছর হতে চললো।
দুজনেই চাকরি করার দরুন সুবীর ও তার স্ত্রী বেশি সময় পায় না ছেলেকে দেখার, আর বাবাকে দেখবে কি করে! কাজের মেয়ে আছে, রান্না করে দুটো খেতে দিয়ে চলে যায়। সারাদিন শুভদীপ বাবুর নিঃসঙ্গতায় দিন কাটায়, কথা বলার মতো কোন লোক নেই, অথচ এই সংসার একদিন নিজের হতে গড়েছে, ছেলেকে মানুষ করেছে; নিজের সুখ ভোগ বিলাসের দিকে কোনদিন কোন ভাবেই নি। তার স্ত্রী সাবিত্রী মাটির মানুষ ছিল, মুখে কোন কথা ছিল না, মুখ বুজে দিনের পর দিন খেটে গেছে সন্তানের জন্য। আজ বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে শুভদীপ বাবুর এই একাকীত্বের জীবনে। একমাত্র নাতিটিকে কাছে আসতে দেয় না। কাছে ডাকলেই পড়ার অজুহাত দিয়ে সাথে সাথেই ডেকে নিয়ে চলে যায় এর ফলে কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেয় না, পাছে সব জেনে যায়, হয়তো সেই সন্দেহ থেকেই। শুভদীপ বাবুর একটি মাত্রই বোন আছে, সে থাকে পাশের পাড়াতে স্ত্রী সাবিত্রী চলে যাওয়ার পর আর তেমন আসতে পারে না; কাউকে বাড়ি আসতে দেয় না, তাই বাধ্য হয়েই তিনি ঘর থাকে ।বাইরে বেরোতে পারে না, ইদানিং হাঁটুর যন্ত্রনায় অনেকটাই বেড়েছে, প্রেসারও বেড়েছে! তাই রাস্তায় একা যেতে ভরসা পায় না। কিন্তু কে নিয়ে যাবে তাকে রাস্তায়, অগত্যা দিনরাত ঘর_বারান্দা করেই দিন কাটিয়ে দিতে হয়। নিজের বোনটি দেখা করতে এলে দেখা করতে দেয়,এলে বলে দেয়:
…. বাবা ঘুমোচ্ছে, একটু আগে ঘুমালো; এখন ডাকলে ঘুমটা হবে না। বাবা বেশি ঘুমায় না। আর এখন ঘুমালো, আর মাসি আপনি এখনই এলেন…!
…. না ঠিক আছে, না আর ডাকতে হবে না ভাইকে। উঠলে বলে দিও আমি এসেছিলাম।
বোন মনে মনে ঠিক জানে, ইচ্ছা করেই দেখা করতে দিল না। সে জানে তার দাদা তাকে কতটা ভালোবাসে সেই ছোটবেলা থেকেই। তাইতো বোন দাদার পাশেই বাড়ি করলো, যাতে দুই ভাই বোন মাঝে মাঝেই দেখা করতে পারে। কিন্তু হয় রে কপাল ! কাছে থেকেই বা কি লাভ হলো; সেই দাদার মুখটা পর্যন্ত দেখতে পায় না।
সুবীররা বেশি ছুটি পায় না,কঙ্কনা যদিও একটু পায়। তাই প্রতিবার পূজোর সময় ওরা ওদের ছেলেকে নিয়ে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। প্রতিবারই ওদের বাবার সাথে কাজের মেয়েকে রেখে চলে যায় বেড়াতে। ওদের টিকিট হয়েছে পূজোর ছুটিতে, শিলং যাবে। যাওয়ার ঠিক আগের দিন কাজের মেয়ে জানালো ওর বরের খুব শরীর খারাপ হাসপাতালে ভর্তি, তাই কয়েকদিন আসতে পারবে না, আর থাকা তো দূরের কথা! সুবীর বলল:
….এবার কি হবে? এতো প্ল্যান করলাম, টিকিট কনফার্ম, হোটেল বুক হয়েগেছে।এবার কি হবে কঙ্কনা!
…..একটা উপায় তো বার করতেই হবে! বাবাকে তো রেখে যাবো, কিন্তু কার কাছ! মালতি তো আসবে না বললো।
…..আমাদের মাসী কে বললে হয় না!
…..না গো, এতো দিন আসতে দেই নি, আর এখন যদি আসতে দেই তবে সবটাই জেনে যাবে যে! কি হবে এবার!
……দাড়াও, বাবাকে আগে জিজ্ঞাসা করি, বাবা একা থাকতে পারবে কিনা ! যদি থাকতে পারে, তাহলে আমি বেশি করে রান্না করে রেখে যাবো।
…..ঠিক বলেছো, গুড আইডিয়া।
……কিন্তু বাবাকে আগে জিজ্ঞাসা তো করো, তবেই না, সবটা প্রবলেম সলভ হবে।
সুবীর তখনই বাবার কাছে গিয়ে বললো:
…… বাবার আমরা তো বেড়াতে যাওয়ার ব্যাবস্থা করেছি,কালীপূজা ভাইফোঁটার পর আমরা ফিরবো। তুমি কি একা থাকতে পারবে বাবা, তাহলে কঙ্কনা বেশি করে খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে দেবে।
অনেক অভিমান বুকে চেপে রেখে বললো:
……হ্যাঁ রে বাবা , আমায় নিয়ে ভাবিস না। আমি সবটাই পারবো। তোরা ঘুরে আয়,আমি আছি তো, কিছুই হবে না রে, চিন্তা করিস না।
রীতিমতো তাই করলো, একটু বেশি করে রান্না করে রেখে দিল। এবং বাবাকে সবটা বুঝিয়ে বলে দিল কঙ্কনা, কোথায় কি আছে। সুবীর আর কঙ্কনা নিজেদের প্যাকিং ফাইনাল করে নিল। তারপর কালীপূজার আগের দিন ওরা বেরিয়ে পড়লো।
পরের দিন ওরা পৌঁছে গেলো, গিয়ে আনন্দে আর ব্যস্ততার কারনে ওদের বাবার কথা বেমালুম ভুলে গেলো। পৌঁছানোর খবরটাও পর্যন্ত দিল না । বাবা খেলো কিনা, ঠিক আছেন কিনা সে খবরটাও নিল না। বাবা ঘরে যা খাবার ছিল, সেটাই ফ্রিজ থেকে বের করে করে একটু খেলো। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না, বুকের ভিতর কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে গলায় উঠতে চাইছিল, তাই কিছুই আর খেতে পারছিল না, কিন্তু আত্মটাকে বাঁচাতে হবে, সারাদিন কিছু একটু মুখে দেয়। একটা ল্যান্ড ফোন আছে, ফোন আসে করা যায় না, টাকা ভরা নেই।
এভাবে দুই তিন দিন কেটে গেল। আজ ভাই ফোঁটা, শুভদীপ বাবু আজকে দিনটা প্রতিবছর মনটা কাঁদে বোনের জন্য। অনেক বছর ফোঁটা দিতে পারে না। একমাত্র বোনকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। প্রতিবারই বোন আসে মিষ্টি চন্দন নিয়ে ফোঁটা দিতে, কিন্তু হায়! পারে না দিতে। তাই প্রতিবারের মতই এবারও বোন এসেছে মিষ্টি চন্দন নিয়ে। এসে ডাক দিল:
…… দাদা! দাদা! দাদা আছো।
বাইরে থেকে বোনের কণ্ঠস্বর শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে বললো:
…..কে? কে? সুমি তুই। এসেছিস।
বলেই কেঁদে দিলো হাউ হাউ করে।
……কি দাদা, ওরা আবার তোমার উপর অত্যাচার করেছে, তাই না!!
….. না রে,ওরা বাড়ি নেই।
……কোথায় গেছে ওরা?
…….বেড়াতে গেছে।
…… কোথায়?
……. জানি না রে অতো। আমি একা বাড়িতে। মালতিও আসছে না।
…… তাহলে খাচ্ছ কি দাদা?
…… ওই যে ফ্রিজে খাবার রেখে গেছে, ওই না খাওয়ার মতো খাচ্ছি।
……ওই ভাবে খাওয়া যায়!
…… কি আর করবো রে!
……. ওরা তোমাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেলো! কি করে গেলো! আমি ভাবতেও পারছি না!
……. ওরা পারে রে, সব পারে!
…… দেখো এতো কিছু হয়ে গেলো, আমায় একটুও জানালো না! আমায় তো অন্তত বলে যেতে পারতো। না হলে আমার কাছে রেখে যেতে পারতো!
…… জানিস তো ওরা আমাকে করো সাথে কথা বলতে দেয় না। কাউকে আসতে দেয় না বাড়িতে। এমনকি তোকেও ঢুকতে দেয় না।
…… সে তো জানি। এবার বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।
…… দেখ না, বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে। যাতে কেউ না আসতে পারে। আমি জানতাম না তালা দিয়ে গেছে। যাওয়ার পর দেখলাম, বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দেখে মনে খুবই কষ্ট পেয়েছি।
…… তোমাকে কি জেল খানার কয়েদি পেয়েছে। না চিড়িয়াখানার পশু পেয়েছে, খাঁচায় বন্দী করে দেখবে।
…… কি বলবো রে ,সবই আমার কপাল!আমার কপাল!
….. একদিকে ভালই হলো।এবার একটা ফোঁটা পাবো। কত বছর তোর ফোঁটা পাই না।
….. কিন্তু দিবি কি করে, বল!
…… আর কি। আমাদের মাঝে কোন বাঁধাই আমাদের ভাই বোনের সম্পর্ককে আলাদা করতে পারবে না।
…… কিন্তু কি করে!
…… তুমি গ্রিলের কাছে এসো দাদা, আমি গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে তোমাকে ফোঁটা দেবো, মিষ্টি মুখ করবো।
….. সেটাই কর। এটাই শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে প্রাপ্য ছিল রে।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বোন দাদার কপালে তিনবার মন্ত্র বলে ফোঁটা দিল। মিষ্টি মুখ করলো। আনন্দে দাদার চোখে জল এসে গেল। পরে এসে দাদার পছন্দমত খাবার এনে দাদাকে খাইয়ে গেলো ওই গ্রিলের ফাঁকা দিয়েই।
তারপর থেকে রোজ এসে বোন পছন্দ মতো খাবার এনে দাদাকে দিত। কয়েকটা দিন অন্তত বেড়াজালে গণ্ডির মধ্যে থেকেও মুক্তির স্বাদ পেলো। ফ্রিজের খাবার আর খেলো না। ফ্রিজের খাবার সবটাই থেকে গেছে দেখে দাদা শুভদীপ বাবু মনে ভয় পেলো। ছেলেরা এসে কৈফিয়ত চাইবে, এতদিন কি খেয়ে রয়েছি। তাই বোনকে বললো:
…… দাড়া সুমি, একটা কাজ বাকি আছে।
…… কি কাজ বাকি দাদা?
……. এই নে ফ্রিজের সব খবর ,তুই দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আয়, কুকুর খেলে নেবে।
…… ঠিক বলেছো দাদা। ওই গুলো আর রাখার দরকার নেই। বুঝতে পারবে। আবার তোমার উপর রাগারাগি বকাবকি করবে। দরকার নেই রাখার।
…..এই নে। কাল বোধ হয় চলে আসবে ওরা। আজকের মতো খাওয়া তো হয়ে গেলো। যা খেয়েছি,আজ আর খাওয়া লাগবে না।
…… হ্যাঁ দাদা দাও।
বলে ফ্রিজের সাত দিনের খাবার নিয়ে চলে গেলো কুকুরকে দিতে।
এভাবেই চললো শুভদীপ এর বাকি জীবন। হয়তো একদিন হয়তো বোন সুমি শুনতে পাবে দাদা আর নেই বেচেঁ। শেষ দেখা টা হয়তো দেখতে দেবে!!

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102