কলমে: মাকসুদা খাতুন:
মা’কে নিয়ে দুই ছেলের মধ্যে ঝগড়া,বিবাদ। প্রায়ই মা’কে নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। অনেক বুঝিয়ে আত্মীয় স্বজন যখন কোনোভাবেই সুরাহা করতে পারল না তখন গ্রামের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করলেন। বড় ছেলে মোকাম্মেল হোসেন তার সিদ্ধান্তে অনড়। কিছুতেই তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সমাধান করতে না পেরে গ্রামবাসী মিলে আদালতের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করলেন।
ফতেহপুর গ্রামের মোতালেব হোসেনের দুই ছেলে কৃষক মোকাম্মেল হোসেন ও মুদি দোকানদার মোজাম্মেল হোসেন। মোকাম্মেল হোসেনের পনের বছরের ছোট মোজাম্মেল হোসেন। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই মোকাম্মেল হোসেন সংসারের সবার দায়িত্ব নেন। অভাব অনটনের সংসারে ছোট ভাই মায়ের দায়িত্ব,ভাইকে সাহায্য করার জন্য ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করে ছেড়ে দিল। পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের ইচ্ছে,ছোট ভাই লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি করুক। মোজাম্মেল লেখাপড়ায় মন না দিয়ে টাকা উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকে। বাধ্য হয়ে স্বল্প পুঁজি দিয়ে ছোট ভাইকে মুদি দোকানে বসিয়ে দিলেন মোকাম্মেল হোসেন। ছোট ছেলে উপার্জন করলেও সংসারের বেশিরভাগ খরচ,মায়ের দেখভাল বড় ছেলে করে। সংসারে সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। মা ফজিলাতুন্নেছা সবদিক ভেবে দুই ছেলের সংসার আলাদা করে দিলেন। সংসার আলাদা হওয়ার পর থেকে সমস্যা হলো মা’কে নিয়ে। দুই ছেলেই মা’কে নিজের কাছে রেখে মায়ের সেবাযত্ন করতে চায়। বড় ছেলে কিছুতেই মা’কে তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখবে না।
মহামান্য আদালত আজ রায় দেবেন। আদলতে উৎসুক জনতার ভিড়। বিচারপতি এজলাসে আসা মাত্রই সুনসান নীরবতা নেমে আসে। পঁচাত্তর বছর বয়স্ক মোকাম্মেল হোসেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বললেন,’মাননীয় বিচারক,খুব ছোট থাকতে আব্বাকে হারাইছি। এরপর থেকে মা-ই আমার সব। মায়ের বয়স সাতানব্বই বছর। আপনের কাছে আমার একটাই আর্জি, আমার বৃদ্ধা মা’কে সেবাযত্ন করার সুযোগ থেকে আমাকে,আমার পরিবারকে বঞ্চিত করবেন না।’
মহামান্য বিচারপতি নিস্পলক চোখে রুদ্ধশ্বাসে সব শুনছেন। সিক্ত চোখে ছোট ছেলে জানালো, ‘মাননীয় আদালত,ছোটবেলা থেকে পিতাসম বড় ভাই মায়ের দায়িত্ব পালন করে আসতেছে। ভাইয়ের বয়স বাড়ছে। এখন ওনার অনেক সেবাযত্নের প্রয়োজন। মা বড় ভাইয়ের একার না। আমারও মা। মায়ের সেবা থেকে কেন আমি, আমার পরিবার বঞ্চিত হবো? দয়া করে আমার গর্ভধারিনী মমতাময়ী মা’কে আমার কাছে রেখে সেবা করার অনুমতি দিন।’
গ্রামের অশিক্ষিত, দরিদ্র দুই ছেলের মাতৃভক্তি দেখে মাননীয় বিচারক বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ। ওনার চোখ থেকে নিঃশব্দে নোনা অশ্রু ঝরছে। নিজের মায়ের মুখটি তিনি ভুলতে বসেছেন। শেষ কবে মা’কে দেখতে বাড়ি গেছেন মনে করতে পারছেন না। টিস্যু চেপে ধরলেন চোখে। কি রায় দেবেন তিনি জানেন না। নিরুপায় হয়ে তিনি দুই ছেলের বৃদ্ধা মায়ের কাছে আসলেন।
‘মা,আপনার দুই ছেলে আপনাকে তাদের কাছে রাখতে চায়। আপনি কোন ছেলের কাছে থাকতে চান?’
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে অস্পষ্টস্বরে জবাব দিলেন,
‘বাজান,আমার মোকাম্মেল অনেক রোগা হয়ে গেছে। তার বয়স বাড়ছে। তার অনেক যত্নআত্তির দরকার। বিশ্রাম দরকার। আমার বাকি জীবন ছোট ছেলে মোজাম্মেলের কাছে থাকবার চাই।’
অশ্রুসজল চোখে মহামান্য বিচারপতি মায়ের ইচ্ছেকেই কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দিলেন। ব্যস্ততার অজুহাতে মা’কে নিজের কাছে রেখে মায়ের সেবা করতে পারেন নি।
আজ শুধু মায়ের মুখটিই বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পরদিন সিক্ত চোখে মা’কে নিজের কাছে রাখার জন্য গ্রামের উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন………