বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ অপরাহ্ন

ছোটগল্প-স্মৃতি

Coder Boss
  • Update Time : শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৫১ Time View

লেখক: মাকসুদা খাতুন দোলন

নাজু বাংলা সাহিত্যের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মা-বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে
কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখে মা রুটি সেঁকে হটপটে রাখছেন। মা’কে এখনি শিমুলের জন্মদিনের কথা বলবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। শিমুলের বার্থডেতে কিছু গিফট দিতে চায়। টাকার প্রয়োজন। মা কি যেতে দিবে? আমতা আমতা করে
বলেই ফেলল,’মা একটা কথা ছিল। আগে বলো যেতে দেবে?’
টেবিলে নাস্তা দিতে দিতে দিলারা বেগম বললেন,’কোথায় যেতে হবে?’
‘বন্ধু শিমুলের জন্মদিন। সবাই ওকে উইশ করতে বাসায় যাবে। আমিও যেতে চাই। কিছু টাকা লাগবে,গিফট কিনবো।’
নাজুর বাবা পেপার হাতে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘সাতসকালে মা মেয়ে কি নিয়ে কথা বলছো?’
‘বলছিলাম আজ সবজি করিনি। শুধু আলু ছিল, তাই
ডাল করেছি। ডাল দিয়ে রুটি খেতে হবে।
‘কি আর করা! যাই আছে দাও তাড়াতাড়ি। অনেক হেঁটেছি। হাঁটলে ক্ষুধা বেড়ে যায়।’
নাজু নাস্তা করে নিজের রুমে চলে আসলো। মায়ের সাথে কথা শেষ করতে পারলো না। রেডি হয়ে ভার্সিটিতে চলে যায়। ক্লাস শেষে ফেরার পথে শিমুল পিছন থেকে ডেকে
বললো,’জন্মদিনে আসছো তো! আমার বিশেষ দিনে তোমাকে কিছু বলতে চাই।’
‘কি কথা বলবে? এখনি বলো।’
‘কালকেই বলবো। ঠিক সময়ে চলে এসো।’
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে মাকে টাকার কথা বলার জন্য রুমে ঢুকে দেখতে পেল মা বয়েস কলে কার সাথে কথা
বলছিল। মেয়েকে দেখে লাইন কেটে বললেন,
‘জন্মদিন কবে? কবে যেতে চাস?’
‘কালকে বিকেলে। একটু আগে বের হবো। মিতাকে নিয়ে ওর জন্য কিছু গিফট কিনে তারপর যাবো।’
পরদিন মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভালো ব্রান্ডের
দামী পারফিউম কিনে শিমুলের বাসায় গেল। একে একে অনেক বন্ধু বান্ধবী আসলো। গান,গল্প আড্ডা চলছে। নাজু শিমুলের মুখ থেকে বিশেষ কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। শিমুল কেন এখনও কিছু বলছে না? কেক কাটার সময় শিমুল নাজুকে পাশে রেখে কেক কাটলো। উভয় উভয়কে খাইয়ে দিল। এক ফাঁকে শিমুল নাজুর কানের কাছে ছোট্ট করে বলল,’খুব ভালোবাসি তোমায়।’ মুচকি হেসে সম্মতি দিয়ে দিল নাজু। দু’জনে একসাথে ছবি উঠালো,কিছু সময় গল্প করলো। খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যার পর বান্ধবী মিতার সাথে বের হলো। মিতা ওকে
নামিয়ে বাসায় চলে গেল। ফিরে এসে দেখে নাজুর বাবা
ড্রইং রুমে টিভি দেখছে। বেশি রাত হয়নি তাই তেমন কিছু বলেননি। মা শুধু বললেন,’ভালো করেছিস তাড়াতাড়ি ফিরে। এখনি ফোন দিচ্ছিলাম। চা খাবি তো?’
‘না, অনেক খাওয়া হয়ে গেছে! এখন চা টা খাবো না।’

শিমুলের সাথে রিলেশন হওয়ার পর নাজু অনেক সময় নেটে থাকে। ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করে,ভিডিও কলে কথা বলে রাত জাগে। সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠে।
মা-বাবার সাথে আগের মতো এক সাথে খাওয়া-দাওয়া,
গল্প করা হয় না। বেশ কিছুদিন পর নাজুর ভিতর পরিবর্তন আসলো। হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। কারো সাথে কথা বলে না। একাকী থাকতে পছন্দ করে। বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে
দরজা ভিড়িয়ে থাকে। নাজুর মা-বাবা খাবার খেতে ডাকতে গেলে বলে,
‘বিরক্ত করো না। একা থাকতে দাও। আমার ঘর থেকে যাও এখন।’
মেয়ের এমন ব্যবহার আশা করেননি নাজুর মা-বাবা।
হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। মেয়ের এই রকম পরিবর্তনের
কোনো কারণ খুঁজে পান না। উপায় না পেয়ে ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিলেন। ডাক্তার বন্ধু মেয়েকে একজন সাইকোলজস্টিট এর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। নাজুর বাবা বন্ধুর সহযোগিতায় একজন
সাইকোলোজিস্ট এর নাম ঠিকানা,ফোন নাম্বার লিখে
নিলেন। পরদিন সকালে নাজুকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলেন মা-বাবা। দেখলেন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে নাজুর বাবা বললেন,
‘মা চল্ নাস্তা খাবি। তারপর সবাই মিলে তোর ছোট ফুপির বাসায় বেড়াতে যাবো। অনেকদিন যাই না।’
নাজু চোখ বন্ধ করেই বলল,’আমি যাবো না। তোমরা যাও।’ নাজুর মা খেয়াল করলেন নাজুর মোবাইল সুইচ অফ
খাটের সাইট টেবিলে রাখা। যে মেয়ে এক মুহূর্তের জন্য
মোবাইল ছাড়া থাকে না সে কিনা এখন ধরছেই না।
হয়েছে কি মেয়ের? আস্তে আস্তে মেয়ের গায়ে হাত রেখে
বললেন,’মা আর দেরি করিস না! খেতে চল! খেয়ে দেয়ে তোর ফুপির বাসায় যাবো।’
এক ঝটকায় মায়ের হাতটি সরিয়ে দিল নাজু। চোখ
মেলে মায়ের দিকে ফিরে রাগে বললো,’একবার বলেছি না আমি যাবো না। তোমরা যাও। কথা কানে যায় না? কেন বিরক্ত করছো?’নাজুর মা-বাবা আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রুম থেকে বের হয়ে আসলেন।
সাইকোলোজিস্ট সুলতানা জামানকে নাজুর বাবা ফোন দিলেন,
‘ম্যাম মেয়েকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না আপনার চেম্বারে আসার জন্য।’
‘ঠিক আছে, আমি আসছি। আপনার বাসার ঠিকানা বলুন।’
নাজুর বাবা সুলতানা জামানকে ঠিকানা বলে দিলেন। ঘণ্টা
দুয়েক পর সুলতানা জামান নাজুর বাসায় আসলেন।
এসে দেখলেন নাজুর মা-বাবা বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বসে আসেন। নাজুর ঘরের দরজা ভিড়ানো। রুমে ঢুকলেন পিছনে পিছনে নাজুর মা এসে ঘরের আলো জ্বালালেন।
মেয়েকে ডাকলেন,’নাজু দেখ্ কে এসেছে!’
নাজু এলো চুলে চোখ মেলে তাকাতেই সুলতানা
জামান হেসে বললেন,’আমি তোমার আন্টি হই। তোমার
মায়ের সম্পর্কের খালাতো বোন। দেশের বাইরে ছিলাম
অনেক বছর। দেশে এসেই তোমার মায়ের কথা মনে হলো চলে আসলাম।’নাজু কথাগুলো শুনে একবার দেখে অন্য দিকে ফিরে থাকে। সুলতানা জামান নাজুর পছন্দের আচার,চকলেট বের করে সামনে রেখে বললেন,
‘নাজু তুমি দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছো। সেই ছোট্ট সময় দেখেছি। চুল এলোমেলো রেখেছো কেন?’নাজুর প্রশংসা করতে করতে সুলতানা জামান চুল আঁচড়ে দিলেন। নিজের মোবাইল থেকে দেশের বাইরের কিছু দৃশ্য নাজুকে দেখতে দিলেন। নাজু কোনো কথাই বলছে না। চুপচাপ সবকিছু দেখছে কথা শুনে যাচ্ছে। সুলতানা জামান নাজুর মুখে চকলেট দিয়ে বললেন,’খুব মজা খেয়ে দেখো। ভেতরে বাদাম দানা পাবে। নাজু কালকে আমার সাথে একটু পার্কে যাবে? অনেক আগে গিয়েছি এখন কিছুই মনে নেই।’
নাজু শান্ত গলায় বলল,’মাকে নিয়ে যাও। আমার বাইরে
যেতে ভালো লাগে না।’সুলতানা জামান নাজুর গাল ছুঁয়ে আদর করে বললেন,’তৈরি থেকো! কালকে তোমার পছন্দের আরও একটা জিনিস নিয়ে আসবো।’

পরদিন সুলতানা জামান নাজুকে অনেক বুঝিয়ে আদর করে নিয়ে চলে আসলেন পার্কের খোলা আকাশের নিচে। সুন্দর জায়গা দেখে দু’জনে বসলেন। আসার সময় নাজুর পছন্দের চকবার আইসক্রিম সাথে আনেন। খেতে খেতে বললেন,
‘নাজু আমি লক্ষ্য করছি, কোনো কারণে তোমার মনটা
খুব খারাপ হয়ে আছে। আমাকে বলা যায় না?’
‘কই না তো ! মন খারাপ নেই।’
‘নাজু,আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আমার কাছে বলো।
তোমার মনটা হালকা হবে। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘এইসব বলা যায় নাকি? নোংরা কথা লোকে জানলে কি বলবে? আমাকে দাম দিবে না। নিজেদের কথা কেউ কাউকে বলে?’
‘তুমি আমাকে সব বলো। তোমার ভালোর জন্য বলছি।
তুমি হতাশায় ভুগছো। এই কয়েক মাসে কি ঘটেছে তোমার জীবনে?’
নাজু আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বলতে শুরু করলো,
‘মা,বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি,খুব শ্রদ্ধা করি। ওনারাও আমার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেননি। একদিন
আবিষ্কার করলাম বাবার দ্বিতীয় বউয়ের মেয়ে আমি। মা’কে কখনো প্রশ্ন করিনি। ওনাদের কখনো বুঝতে দেইনি আমি বিষয়টি জেনে গেছি। মনে হাজার প্রশ্ন আসলেও
প্রকাশ করিনি। ভিতরে চেপে রেখে দগ্ধ হয়েছি।
তারা তো সুখে আছেন। তাই নানা রকম প্রশ্ন করে সুখের সংসারে আগুন লাগাতে চাইনি। তবে ভেতরে একটা কষ্ট থেকেই গেছে। একদিন রাতে মা খালায় বাসায় কোনো কারণে থেকে গেল। বাথরুমে যাবো দেখি বাবার মোবাইলে ম্যাসেজের টুংটাং শব্দ। বাবা ঘরে নেই। ভাবলাম দেখি এত রাতে কে নক করেছে- ‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি। প্লিজ তোমার একটা ছবি পাঠাও। চলো একদিন দেখা করি।’
‘নাজু কাকে ভালোবাসো?’
‘আমার কথা না। রোকসানা আক্তার নামে এক মহিলা
বাবাকে ম্যাসেজ করছিল। সবগুলো পড়লাম। অনেকগুলো পড়ার মতো ছিল না। বাবা যাতে বুঝতে পারে আমি ম্যাসেজগুলো ডিলিট করে দিয়েছিলাম। বাবা বুঝতে পেরে
নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছিলেন হয়তো কিন্ত ঐদিনের পর থেকে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারিনি ঐ কথাগুলো। মাকে জানাইনি যদি দু’জনের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর থেকে বাবার সংজ্ঞাটা আমার কাছে পাল্টে যায়। প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম। বিশ্বাস আর ভালোবাসা আমার কাছে কোন মূল্যে নেই। একদিন রাতে শিমুলের সাথে চ্যাট করছিলাম হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে কিছু ছবি আসলো। শিমুলের সাথে একটা মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের
কিছু ছবি। শিমুলের কাছে জানতে চাইতেই ও সব কিছু
থেকে আমাকে ব্লক করে দিল। ফোনে ট্রাই করবো নাম্বারটা রিজেক্ট কলে রেখে দিল। ভাবলাম মায়ের ফোন থেকে একটা ফোন করবো শিমুলকে। মায়ের ঘরে ঢুকবো দেখি দরজা ভিড়ানো আলো জ্বলছে উঁকি দিয়ে দেখলাম, মা ভিডিও কলে কারো সাথে কথা বলছে। আমার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি কেটে দিয়ে ফোনটা লুকিয়ে ফেললো। এমন কিছু ছিল যা আমাকে দেখানো সম্ভব ছিল না। আমি ফোনটা আর চাইলাম না। জানতেও চাইলাম না মা কার সাথে কথা বলছে। বিশ্বাস,ভালোবাসা,সম্পর্কের কোনো দাম নেই আমার কাছে। এইসব কিছু অর্থহীন। এখন কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। ঘুমের ঔষধ খেতে চেয়েছি কয়েকবার পারিনি। আন্টি, তুমি আমার কথাগুলো আর কাউকে বলো না কিন্তু। আমি দূরে কোথাও চলে যেতে চাই
অনেক দূরে।
‘দূর পাগলি! আমি কাউকে বলবো না। নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে না বলো? কেন ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিজের ক্ষতি করবে?কেন নিজেকে শাস্তি দেবে? মনে রেখো, নিজেকে ভালো রাখতে হবে। নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে।’
সুলতানা জামান নাজুকে নিয়ে বাসায় পৌঁছলে নাজুর মা-বাবা অস্থির হয়ে কাছে আসেন। চোখে মুখে টেনশনের ছাপ। নাজু কোনো কথা না বলে সোজা তার রুমে চলে যায়। সুলতানা জামান আড়ালে নাজুর মা বাবাকে ডেকে আনেন। নাজুর বাবা গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন,
‘কোনো কারণ খুঁজে পেলেন ম্যাডাম? নাজু ভালো হয়ে যাবে তো? মেয়ের এই অবস্থা কিছুতেই মানতে পারছি না। খুব কষ্ট পাচ্ছি।’
সুলতানা জামান নিজের মোবাইল বের করে বললেন,
‘যে নাম্বার থেকে কল করেছিলেন সেটাই কি আপনার হোয়াটস এপস নাম্বার?’
নাজুর বাবা কৌতুহল চোখে উত্তর দিলেন,’জ্বি ম্যাম।’
সুলতানা জামান গোপনে নাজুর কথাগুলো রেকর্ড করেছিলেন। মোবাইল ধারণকৃত সব অজানা কথার
রেকর্ড নাজুর বাবার হোয়াটস এপসে সেন্ড করে বললেন,’নাজু কিছু বাজে স্মৃতি নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছে।
যার পরিণাম ভয়াবহের দিকে এগুচ্ছিল। রেকর্ডের
কথাগুলো শুনলে সবকিছু পরিস্কার হবে। আজ থেকে
মেয়েটাকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন। নাজু আপনাদের
দু’জনকে অনেক বেশি ভালোবাসে। সব সময় মেয়েটার
কাছাকাছি থাকবেন। পারলে আট দশদিন বাইরে কোথাও ঘুরতে চলে যান।’
সুলতানা জামান চলে যাওয়ার পর নাজুর মা,বাবা
মোবাইল থেকে রেকর্ডের কথাগুলো শুনলেন। দু’জনই নির্বাক,নিস্তব্ধ……..

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102