কলমে: মুরাদ হাসান
এক ছিল আলৌকিক রাজ্য, যা ছিল মানুষের লোকালয় হতে বহু দূরে, এক গভীর রহস্যময় বনের মাঝে। সে রাজ্যের ছিল এক বিশেষত্ব—সেখানে পশুপাখিরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারত! কিন্তু বিচিত্র ব্যাপার হলো-সে রাজ্যে কোনো প্রজা ছিল না, ছিল শুধু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল রাজপ্রাসাদ। আর সেই রাজপ্রাসাদে বাস করত এক রাজা ও তার রানি।
তাদের জীবন রাজকীয় হলেও একাকীত্ব তাদের মাঝে নিঃশব্দ শূন্যতা তৈরি করেছিল। প্রাসাদের সোনালি দরজাগুলো যেমন বিশাল, তেমনই নিঃসঙ্গ। দীঘির জলে যেমন চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়ত, তেমনই সেখানে খেলা করত নির্জনতা।
কোন একদিন দুপুরের রাজা-রানি আহারের সময়; রাজপ্রাসাদের ঝুলন্ত জানালার পাশে এসে বসল একটি ছোট্ট হলুদ পাখি। তার চোখে ছিল ক্লান্তি, শরীর ভরে ছিল দীর্ঘ পথচলার ধুলোয়। ছোট্ট পাখিটি ভগ্নস্বরে রাজাকে বলল,
“রাজামশাই, আমি ক্ষুধার্ত। একটু খাবার দেবেন?”
কিন্তু রাজা তা কর্ণপাত করলেন না। তিনি চুপচাপ আহার করতেই থাকলেন, যেন কোনো কিছুই শোনেননি। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে পাখিটি পাখা মেলল, একটুও দেরি না করে উড়ে চলে গেল বিস্তীর্ণ আকাশের দিকে।
……..
কিছুদিন পর, রাজা ও রানি প্রাসাদ ছেড়ে বনভ্রমণে বের হলেন। ঘন গাছপালার মধ্যে তারা বুঝতে না পেরে পথ হারিয়ে ফেললেন। রোদ তখন নেমে এসেছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে তারা এক বিশাল বৃক্ষের ছায়ায় বসে পড়লেন।
সেই গাছের ডালেই ছিল সেই হলুদ পাখিটির বাসা। সে উপর থেকে তাদের দেখল, বুঝল তাদের দুর্দশা। এবার সে আর দেরি করল না। ডানা মেলে উড়ে এলো রাজা-রানির পাশে। তার ছোট্ট হৃদয়ে ছিল মমতা। সে বনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রসালো ফল সংগ্রহ করে এনে তাদের দিল।
রাজা-রানি ক্ষুধা নিবারণ করলেন, প্রাণ ফিরে পেলেন। তাদের মনে তখন এক গভীর অনুশোচনা।
“তুই সত্যিই দয়ালু!” রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
রানি কৃতজ্ঞতায় তার গলা থেকে খুলে দিলেন তার সোনার মালা, পরিয়ে দিলেন পাখিটির গলায়। কিন্তু তাতেও পাখিটির চোখে খুশির আলো ফুটল না।
রানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মন খারাপ কেন?”
পাখিটি স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “আপনাদের যদি একটি কন্যাসন্তান থাকত, তবে আমি তাকে নিয়ে খেলতাম, ফুল এনে দিতাম, চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখাতাম। আমার তো আপনাদের ছাড়া আর কেউ নেই!”
পাখিটির কথা শুনে রাজা-রানি চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর রানির চোখে জল এলো। তিনি বললেন,
“আমি একদিন এক স্বপ্ন দেখেছিলাম… যদি আমি মেঘফল নামের এক বিস্ময়কর ফল খেতে পারি, তবেই আমাদের ঘর আলো করে আসবে এক ফুটফুটে কন্যা। কিন্তু সেই ফলের গাছ আমরা খুঁজে পাইনি!”
পাখিটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে উচ্ছ্বাসে বলল,
“আমি চিনি সেই গাছ! তবে সে গাছ বছরে মাত্র একবার ফলে দেয়, আর কিছুদিন আগেই তার ফল ঝরে গেছে।”
রাজা-রানি শুনে হতাশ হলেন, যেন হঠাৎ তাদের সমস্ত স্বপ্ন হারিয়ে গেল।
কিন্তু পাখিটি দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিজ্ঞা করল, “আগামী বছর আমি আপনাদের জন্য সেই মেঘফল এনে দেব!”
এরপর থেকে হলুদ পাখিটি প্রতিদিন রাজপ্রাসাদে যেত, রাজা-রানির সঙ্গে গল্প করত, আহার করত। সময় কেটে যেতে লাগল এভাবে ।
………..
অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত সময় এলো—মেঘফলের আগমনের মৌসুম!
পাখিটি রাজা-রানির আদেশে উড়ে গেল সেই গাছের সন্ধানে। যেতে-আসতে সময় লাগবে অন্তত দুই দিন।
কিন্তু দুদিন পেরিয়ে গেল, পাখিটির দেখা নেই!
রাজা-রানি উদ্বেগে পড়লেন। তাদের মনে হলো, হয়তো কোনো বিপদ ঘটেছে!
তৃতীয় দিন সকালে…..
রানি যখন বাগানে ফুলগাছে পানি দিচ্ছিলেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন—দূর আকাশে এক সোনালি আলোর রেখা!
সেই হলুদ পাখিটি ফিরে এসেছে! আর তার ঠোঁটে ধরা রয়েছে সেই স্বপ্নের মেঘফল!
রানি আনন্দে চকিতে ফলটি আনা মাত্র-ই গ্রহণ করলেন, আর দেরি না করে খেয়ে ফেললেন। পাখিটির চোখে খুশির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল—তার সমস্ত পরিশ্রম সফল হয়েছে!
…………
দিন গড়িয়ে বসন্ত এলো। চারপাশে পাখির কলরব, ফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল রাজপ্রাসাদ। আর সেই বসন্তেই রাজা-রানির ঘর আলো করে এলো এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান!
রাজা কন্যার নাম রাখলেন “ফুলকলি”—একটি কোমল, স্নিগ্ধ ফুলের মতো, সে যেন বসন্তের বার্তা নিয়ে এসেছে।
এই আনন্দ সংবাদ শুনে হলুদ পাখিটি ছুটে এলো। সে তার নিজের গলার সোনার মালাটি খুলে ফুলকলির গলায় পরিয়ে দিল।
রাজপ্রাসাদ আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
রাজা পাখিটির জন্য একটি মুক্ত সোনার খাঁচা তৈরি করালেন, যেখানে সে যখন খুশি উড়ে যেতে পারবে, আবার ফিরে আসতে পারবে।
ফুলকলি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল, আর হলুদ পাখিটি হয়ে উঠল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
তাদের সঙ্গে বন্ধু হলো আরও বনের অন্যান্য প্রাণীর—হরিণ, ভাল্লুক, ময়ূর।
তারা সবাই একসঙ্গে গড়ে তুলল এক নতুন ভালোবাসা ও বন্ধুত্বে ভরা এক সুখের রাজ্য।
এভাবে-ই তাদের দিন কাটতে লাগলো পরম সুখে।
—
(সমাপ্ত)