কলমেঃ তুষার আহমেদ
================
শহরটা যেন কংক্রিটের পাথরে গড়া এক বিশাল জঙ্গল। প্রতিটা সকালে এখানে সূর্য ওঠে, কিন্তু তার আলো যেন ধোঁয়া আর ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়। আনাচে-কানাচে হাজারো মুখ, হাজারো স্বপ্ন—তারই ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে তানভীর।
তানভীর একা। বয়স খুব বেশি না, বড়জোর একুশ-বাইশ। কাঁধে একটা পুরোনো ব্যাগ ঝুলছে, পায়ে ছেঁড়া স্নিকার্স। মুখের ওপর নেমে আসা চুলের ভেতর লুকিয়ে থাকে তার চোখের বিষণ্ণতা।
সে এই শহরে এসেছে নিজের স্বপ্ন খুঁজতে—কিন্তু শহর যেন ধীরে ধীরে তাকে গিলে ফেলছে।
সকালের আলো ফুটতেই সে বেরিয়ে পড়ে। হাতে পুরোনো একটা ক্যামেরা, ঘুরে বেড়ায় গলি থেকে গলিতে। ছবি তোলে—মানুষের, জানালার, রিকশার চাকায় জমে থাকা বৃষ্টির পানির। নিজের মনেই ভাবে, একদিন এই ছবিগুলো দিয়ে বড় একটা প্রদর্শনী করবে। শহর তাকে মনে রাখবে।
কিন্তু শহর কি কখনও কারও স্বপ্ন মনে রাখে?
প্রতিদিন বিকেলে তানভীর বসে থাকে পুরোনো লাইব্রেরির পেছনের দেয়ালের কাছে। হাতে একটা নোটবুক, ভেতরে এলোমেলো কিছু লেখা। সে লেখে নিজের গল্প, শহরের গল্প। লেখে কীভাবে শহরটা আস্তে আস্তে তাকে গিলে ফেলছে।
একদিন সন্ধ্যায় দেখা হয় মায়ার সঙ্গে। কাঁধে ক্যানভাসের ব্যাগ, এলোমেলো চুল, চোখে যেন হাজারো অসমাপ্ত ছবি।
তানভীর প্রথমবার নিজের স্বপ্নের কথা কাউকে খুলে বলে।
মায়া শুধু শুনতে থাকে। মাঝে মাঝে হালকা হেসে বলে,
— “শহর তো এমনই… কারও স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে, কারও স্বপ্ন গিলে ফেলে।”
তানভীর জানতে চায়,
— “তোমার স্বপ্নটা কী?”
মায়া তাকিয়ে থাকে দূরের দিকে। তারপর বলে,
— “শহরের এক কোণে নিজের একটা ছোট্ট স্টুডিও হবে… যেখানে শুধু ছবি আঁকা হবে।”
শহরটা নিঃশব্দে তাদের কথা শুনে যায়।
সেই রাতে তানভীরের ক্যামেরায় ধরা পড়ে একটা ছবি—একটা পুরোনো দেয়ালের নিচে দুইজন স্বপ্ন দেখা মানুষ।
তানভীর জানে না শহর তাকে মনে রাখবে কি না। মায়া জানে না তার স্টুডিও কোনোদিন হবে কি না।
কিন্তু সেই রাতে তারা দুজনেই প্রথমবার মনে করে—হয়তো শহর সব স্বপ্ন গিলে ফেলে না। কিছু স্বপ্ন জমিয়ে রাখে… ঠিক কোনো এক অন্ধকার গলির শেষ কোণায়।
সেই রাতের পর থেকে তানভীর আর মায়া যেন শহরের ভেতর একটা ছোট্ট আশ্রয় খুঁজে নেয়—একটা নিঃশব্দ আশ্রয়। বিকেল হলেই তারা দেখা করে লাইব্রেরির পেছনের দেয়ালে। তানভীর ছবি তোলে, মায়া খাতা খুলে আঁকে। কেউ কাউকে তাড়া দেয় না, শুধু পাশে থাকে।
একদিন মায়া বলল,
— “তোমার তোলা ছবিগুলো আমাকে দাও… আমি তাতে রঙ বসিয়ে দেব। আমাদের দুজনের স্বপ্ন মিশে যাক।”
তানভীর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
শহর কি কখনও স্বপ্ন ভাগ করে নেয়?
দিনগুলো কেটে যায়। তাদের হাত ধরে তৈরি হতে থাকে ছোট ছোট ছবি—বৃষ্টিভেজা রিকশা, জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া আলো, ভাঙা দেয়ালের কারুকাজ। তানভীরের ক্যামেরা আর মায়ার তুলি একসঙ্গে একটা নতুন গল্প বলে।
এক রাতে তানভীর বলল,
— “তোমার স্টুডিওটা একদিন হবে, জানো?”
মায়া হেসে বলল,
— “হয়তো হবে… আর যদি না হয়?”
তানভীর নোটবুকের একটা পাতায় লিখল,
“যে স্বপ্ন একা দেখা হয়, তা হারিয়ে যায়…
কিন্তু যে স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়া হয়, তা বেঁচে থাকে চিরকাল।”
সেই কথাটা যেন শহরের দেয়ালে আঁকা হয়ে গেল অদৃশ্য কালি দিয়ে।
বছর খানেক পর শহরের এক কোণে খুলল ছোট্ট একটা স্টুডিও—দেয়ালে টাঙানো কিছু ছবি আর রঙিন ক্যানভাস। দরজার পাশে ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা—
“নিশব্দ স্বপ্ন”
শহরটা হয়তো অনেক কিছু ভুলে যাবে…
কিন্তু গলির শেষ কোণায় রাখা কিছু স্বপ্ন কখনও হারায় না।
স্টুডিওতে আসে কিছু মানুষ—কেউ ছবি দেখতে, কেউ গল্প বলতে, কেউ নিঃশব্দে সময় কাটাতে। সেই জায়গাটা যেন কোলাহলের শহরে একটুকরো শান্তি।
তানভীর তার ক্যামেরায় শহরের আরও ছবি তোলে। মায়া সেই ছবিগুলোতে রঙ বসায়। ধুলো-মাখা জানালা, বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়া রাস্তাঘাট, পুরোনো ট্রাম—সবকিছুই তাদের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
একদিন এক বয়স্ক ব্যক্তি এসে ছবিগুলো দেখে বললেন,
— “এই শহরটা বড্ড ব্যস্ত… কিন্তু তোমাদের ছবিতে দেখি থমকে থাকা সময়। এটাও তো দরকার, তাই না?”
তানভীর আর মায়া একে অন্যের দিকে তাকাল। হয়তো তাদের স্বপ্ন সত্যিই কেউ বুঝতে শুরু করেছে।
কিন্তু শহর বদলায়। নতুন ভবন ওঠে, পুরোনো গলিগুলো হারিয়ে যায়। একদিন খবর এলো, যেখানে স্টুডিওটা আছে, সেখানে নতুন মার্কেট হবে। তাদের সরে যেতে হবে।
মায়া দীর্ঘক্ষণ দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল,
— “তুই কি ভাবছিস, সব শেষ?”
তানভীর ম্লান হেসে বলল,
— “স্বপ্নগুলো কখনও হারায় না… শুধু ঠিকানা বদলায়।”
তারা নতুন একটা জায়গা খুঁজতে শুরু করল।
অবশেষে শহরের আরেক কোণে পুরোনো কাঠের বাড়িতে খোলা হল “নিশব্দ স্বপ্ন”। এবার শুধু ছবি আর ক্যানভাস নয়—এখানে আসে কবিরা, শিল্পীরা, সঙ্গীতশিল্পীরা।
শহর এখনও ব্যস্ত। স্বপ্ন গিলে ফেলার মতোই রয়ে গেছে।
কিন্তু ভেতরে কোথাও, এক কোণে, কিছু স্বপ্ন টিকে থাকে—
নিশব্দে…