এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী।
আলী আহসান মুজাহিদ ছিলেন বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং আদর্শিক ব্যক্তিত্ব। তিনি তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের সংস্কারে নিবেদিত ছিলেন। ২৩ জুন ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের সুন্দরপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলী আহসান মুজাহিদ। তাঁর বাবা, অধ্যক্ষ আলী আহসান, ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম এবং সমাজ সংস্কারক।
### **শিক্ষা ও নেতৃত্বের বিকাশ**
আলী আহসান মুজাহিদ ছোটবেলা থেকেই মেধাবী এবং দায়িত্বশীল ছাত্র ছিলেন। তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তার শিক্ষাজীবন এগিয়ে নেন। ছাত্রজীবনেই ইসলামী আদর্শের প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের মাধ্যমে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৬০-এর দশকে, যখন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য চরমে পৌঁছায়, তখন তরুণ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্র সংঘে যোগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতি নিবেদিত ছিলেন এবং সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
### **রাজনৈতিক জীবনে অবদান**
আলী আহসান মুজাহিদ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তিনি দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাদেশে ইসলামী নৈতিকতা, সামাজিক সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।
তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক ও বিচক্ষণ রাজনীতিক, যিনি দেশের স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় কাজ করেছেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে চারদলীয় জোট সরকারের অধীনে আলী আহসান মুজাহিদ বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।
### **বিচার ও কারাবরণ**
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে। যদিও এই অভিযোগ নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং অভিযোগগুলোর ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবুও তিনি সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক বিচারের শিকার হন।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ন্যায়বিচারের অভাবের অভিযোগ তোলে।
### **শাহাদাত**
২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর আলী আহসান মুজাহিদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দিয়ে শহীদ করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি ইসলামের পথে অবিচল ছিলেন এবং কোনো ধরনের আপস করেননি। তাঁর শাহাদাত বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
### **উত্তরাধিকার ও প্রভাব**
আলী আহসান মুজাহিদের জীবন ও কর্ম ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। তাঁর নেতৃত্ব, আদর্শ এবং সাহসিকতা এখনও হাজারো কর্মী ও সমর্থকদের অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় কষ্ট বা শাহাদাত কোনো বাধা হতে পারে না।
তাঁর জীবন ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর জন্য একটি আদর্শ। তাঁর ত্যাগ, সংগ্রাম এবং দৃঢ়তা প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। “শহীদ আলী আহসান মুজাহিদ” নামটি তাই শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি নয়, বরং এটি ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক বিপ্লবী ইতিহাস।