মো: বায়েজিদ বোস্তামী- বিশেষ প্রতিনিধি,কিশোরগঞ্জ:
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক ঈদগাহ মাঠ হিসেবে সবচেয়ে সুপরিচিত জনপ্রিয় সর্বজন স্বীকৃত পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামাজ পড়ার জন্য কিশোরগঞ্জ জেলার সদরে মুসল্লীদের প্রাণকেন্দ্র সুপ্রাচীন এই “ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ” অবস্থিত। দেশ বিদেশের কাছে ও দূর-দূরান্ত থেকে আগত মুসল্লীগণ অশেষ নেকি হাসিলের উদ্দেশ্যে শোলাকিয়া ঈদের নামাজে যোগদান করেন।
ঈদের নামাজের আগে থেকেই ১৯৮তম ঈদের নামাজের জন্য সমস্ত ঈদগাহ ময়দান সুসজ্জিত করে নামাজের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সুষ্ঠু ও নিরাপদে ঈদের নামাজ নিশ্চিত করতে ও নাশকতা এড়াতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, RAB, ডিবি, দমকল বাহিনী, আনছার বাহিনী, স্কাউট সদস্যবৃন্দ স্ব শরীরে, বুদ্ধিমত্তা ও সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাস্তা ঘাটে, উঁচু ভবন, প্রতি গলি গলি, মোড়ে মোড়ে, অস্ত্র সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মুসল্লীগণ ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশের সময় ভালোভাবে ইলেক্ট্রনিক দরজার মাধ্যমে চেকিং এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্যগণ সমস্ত শরীর ভালোভাবে পুনরায় চেকিং নিশ্চিত করে শুধু মোবাইল ও জায়নামাজ নিয়ে যেতে অনুমতি প্রদান করেন। এছাড়া ড্রোন ক্যামেরার মাধ্যমে সর্বস্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়।
মুসল্লীগণ ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায় করতে কেউ জায়নামাজ হাতে, আবার কেউ রাস্তা থেকে দশ টাকার বিনিময়ে একটি বড় পলিথিন কিনে নিয়ে যায় ঈদগাহ ময়দানে সারিবদ্ধভাবে পরিচ্ছন্ন ভাবে বসতে। ঈদের ২/৩দিন আগে থেকেই দেশ বিদেশের মুসল্লীগণ আগে থেকেই চলে আসেন এই বরকতময় নামাজ আদায় করতে। ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাস, ট্রাক, পি-কাপ, মাইক্রোবাস, সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমান অশেষ নেকি হাসিলের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদের নামাজে যোগদান করেন।
ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের নামাজ ৩১.০৩.২৫ইং তারিখ সোমবার সকাল ১০.০০ ঘটিকা নির্ধারণ করা হয়। সেই জন্য সকাল ৮.০০ ঘটিকা থেকে বিভিন্ন ধাপে সিডিউল সাজানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১ম পর্ব সকাল ৮.০০ ঘটিকায় সর্বপ্রথম হাফেজ কারী দেলোয়ার হোসেন পবিত্র কুরআন সুললিত কন্ঠে তিলাওয়াতের মাধ্যমে আরম্ভ করেন । ২য় পর্ব সকাল ৮.১০ মিনিট হাফেজ আবুল খায়ের সানাউল্লাহ সাহেব কুরআন ও হাদিসের আলোকে মূল্যবান আলোচনা করেন। তিনিঁ বলেন, দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা গ্রহণ করেছি তা হলো: ইমান মজবুত হয়, হারাম পরিত্যাগ হয়, ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় ও অন্যের ক্ষতি সাধন না করার মানসিকতা তৈরি হয়। ৩য় পর্ব ৮.২০ মিনিট মনোমুগ্ধকর ইসলামি সঙ্গীত পরিবেশন করেন আনোয়ার শাহ আজহারী সাহেব যা উপস্থিত মুসল্লীদের হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গেছে যা মনে প্রশান্তি জাগে। ৪র্থ পর্ব ৮.২৫ মিনিট লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য নিয়ে ইসলামি আলোচনা করেন কিশোরগঞ্জ জেলার বিশিষ্টজন ও গুণীজন জনাব মুজাহিদুর রহমান। ৫ম পর্ব ৮.৩৮মিনিট সংক্ষিপ্ত বয়ান পেশ করেন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম কারী মাওলানা তাকরিম হোসেন। তিঁনি বলেন, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র মাহে রমজানের লাইলাতুল কদর রাতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয় এবং পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে প্রয়োজন অনুযায়ী দুনিয়ায় আয়াত প্রকাশ করেন বলে বিশদ আলোচনা করেন। ৬ষ্ঠ পর্ব ৮.৪৮মিনিট হয়বতনগর মাদরাসার সন্মানিত শিক্ষক মাওলানা জুবায়ের ইবনে আবদুল হাই সংক্ষিপ্ত বয়ানে উল্লেখ করেন মাহে রমজানের মাস মুমিনদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। এছাড়া উল্লেখ করেন শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড তাকওয়া দিয়ে নিরূপণ করা হয়। ৭ম পর্ব ৯.০৯ মিনিট আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মুফাচ্ছিরে কুরআন লেখক ও গবেষক ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের সন্মানিত প্রধান ইমাম মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ সাহেব গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। আজ রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লী অংশগ্রহণ করবেন বলে মন্তব্য করেন। ঈদগাহ ময়দানে বিচ্ছিন্নভাবে এদিক সেদিক মুসল্লীগণ ছবি তোলা ও ভিডিও করা থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন যাতে নামাজের ফয়েজ বরকত থেকে বঞ্চিত না হয়। পরহেজগারি অর্জনের নিমিত্তে মাহে রমজানের রোজা মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করেছেন বলে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এছাড়া বয়ান পেশ করেন কুরআন হচ্ছে হিদায়েতের উৎস। কুরআন হচ্ছে মুমিনদের জন্য রহমত স্বরূপ। যেকোনো জায়গায় ঈদের নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নিজ এলাকায় শুধু ঈদের নামাজ পড়তে হবে এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিঁনি বলেন, যে দেশের মাটি দিয়ে বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ সেই দেশের মাটিতে বান্দার মৃত্যু নির্ধারণ করে রেখেছেন বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহুল বয়ান পেশ করেন।
“আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ”। মাহে রমজানে ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবির পড়তে হয় এবং ঈদুল আযহার সময় তুলনামূলক একটু উচ্চ কন্ঠে তাকবির পড়তে পড়তে ঈদগাহ মাঠে যেতে হবে। এ বিষয় নিয়েও বিশদ আলোচনা করেন। সবশেষে ঈদুল ফিতর নামাজ পড়ার নিয়ম বুঝিয়ে বলেন।
৮ম পর্ব ৯.৪৫ মিনিট শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার জনাব মো: হাসান চৌধুরী। এছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষে পুলিশ বাহিনী কয়েকটি গুলি ছুড়ে শব্দের মাধ্যমে সকাল ১০.০০ ঘটিকায় ঈদের নামাজের কাতার সোজা করা হয় এবং ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ানোর পর খুতবা পড়েন এবং পরিশেষে মোনাজাতের মাধ্যমে উপস্থিত সকল মুসলমানদের মনের গোপন ব্যথা, আকুতি-মিনতি, চাওয়া-পাওয়া, দো-জাহানের মঙ্গল কামনায় জীবিত মৃত সকলের জন্য দু’হাত তুলে চোখের জল ফেলে মনোবাসনা পূরণে প্রাণ খুলে দোয়া করা হয়। ঈদগাহ ময়দান পরিপূর্ণ ভরে যায়, রাস্তা ঘাট, আশপাশের বিল্ডিং সহ আনাচে কানাচে সর্বত্র নামাজের জন্য মুসল্লীগণ দখল করেন। উক্ত ঈদের নামাজে প্রায় ০৬ লক্ষাধিক মুসল্লী একসাথে অংশগ্রহণ করেন। অজু খানার পাশাপাশি পুকুরে পানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিগণ সর্বদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং মূল্যবান আলোচনা অন্যত্র ছড়িয়ে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।