কলমেঃ ইঞ্জিঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম।
মেঠো পথে চলেছিনু এক গাঁ
পথের পাশে এক মুচি
ধরলো টেনে আমার পা!
আহ্ করো কি, করো কি
ছাড়ো আমার পা-ও
সত্যি করে বলো তুমি
আমার কাছে কি চাও?
আমি নই মুচি
জুতা সেলাই করে
জীবনে বেঁচে আছি!
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা
শুনেছি, আপনি কবি,
আঁকবেন কি ভাষায় একজন
মুক্তিযোদ্ধার ছবি?
লিখিবেন স্যার, আমায় নিয়ে
ছোট্ট একটা কবিতা?
সেথায় থাকবে শুধু
আমার জীবন গাঁথা!
উনিশশো একাত্তর সাল, রেসকোর্স ময়দান
শুনতে গেলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষন!
টগবগ করে উঠলো রক্ত
দাড়িয়ে গেলো গায়ের পশম
ভুলে গেলাম পাকিস্তানি শাসন!
পঁচিশে মার্চ, পাকসেনারা করলো আক্রমণ
মারলো হাজার হাজার, নাই কত তা স্মরন!
বন্ধুদের সাথে চলে গেলাম পাশের দেশে
যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরলাম বীরের বেশে!
করলাম যুদ্ধ নয় মাস ধরি
ভুলে গেলাম মা ভাই-বোন ঘর-বাড়ি!
যুদ্ধ শেষে খুঁজলাম নিজ বাড়ীঘর
সবাই বললো মুক্তিযোদ্ধা পরিবার,
হত্যা করেছে মিলিটারি এসে
তোমার মা ভাই, জ্বালিয়েছে ঘর,
তুলে নিয়ে গেছে তোমার জোয়ান বোন
প্রতিবেশী রাজাকার হাশেম তালুকদার!
কি আর করি, অস্ত্র দিয়েছি জমা
না হলে তারে আমি কি করি ক্ষমা?
ভিটেমাটি চালচুলা কিছু নাই আমার
পাশের পাড়ার এক মেয়ে নিলো আমার পিছু,
বললাম, আমি নিঃস্ব সর্বহারা নাই কিছু
ক্যামনে তোমার জীবনের সাথে জড়াই
মুক্তিযোদ্ধা, এতটুকু আছে আমার বড়াই!
মেয়ে ধরলো আমার হাত,
বললো, চোখের জল ফেলি,
তুমি মুক্তিযোদ্ধা, সূর্য সন্তান
ভালোবেসে তোমায়, আমার জীবন করলাম দান!
চললো জীবন টেনেহিঁচড়ে
দিয়ে কামলা কিশান দু'জনে,
একের পর এক এলো সন্তান বুক জুড়ে!
বানালাম ঘর ক্ষেতখামার
সবই খাটায় দু'জনের গা গতর!
'৭৫ এর ঝড়ে ভাঙলো মুক্তিযুদ্ধের বাঙলাদেশ
তবুও দাঁড়ালাম বুকে ভর করি বুলেট সাহস!
একদিন দেখি রাজাকার হাশেম তালুকদার
দাঁত কেলিয়ে হেঁসে কয়,
তুই আছিস বেঁচে আজও, আমার লোকালয়?
দু'দিন পরে এলো পুলিশ, হাতে দিলো দড়ি
অভিযোগ, ডাকাতি করে নিছি অনেক টাকাকড়ি,
সেই সাথে খুন, ৩০২ ধারা নাকি কয়?
মনে মনে হাসলাম, মুজিবের বাংলায়
রাজাকারের হলো আজ জয়!
বিচার শেষে হলো যাবজ্জীবন জেল আর জরিমানা!
যাবজ্জীবন খেটে বের হলাম যখন
জীবন থেকে সব হারিয়ে গেছে তখন!
রোজ রাতে হাশেম তালুকদার
বাড়ীতে দিতো অস্ত্র নিয়ে হানা,
আমার বউকে করবে ধর্ষণ
ছিলো এলাকায় জানা!
একদিন রাতে পাঁচ সন্তান নিয়া
পালালো আমার বউ,
কোথায় গেলো কোন শহরে
জানলো না তা কেউ!
আজ-ও আমি আছি সেই পোতায়
যদি ফিরে আসে সেই আশায়!
পলিথিনের ঘর করেছি, পোড়া ময়লা সব ফেলে
জুতা সেলাই কালি দিয়ে,
আমার জীবন চলে!
মুক্তিযোদ্ধা হতে নাকি অনেক টাকা লাগে!
সাক্ষী যারা দেয় তারা, জন্মে নাই '৭১ এর আগে!
বঙ্গবন্ধু লিখতে যাদের তিনটা কলম ভাঙে
তারাই নেতা, তাঁরাই ত্রাতা
বৃদ্ধের কথা শোনার মত নাই কোন শ্রোতা!
এখনও আমি রাইফেলের বোল্ট কাগ করতে জানি
ওসমানী সনদ গেছে হারায় জেলের ঘানি টানি!
ছেলে-মেয়ে বউ হারিয়ে এজীবন নিয়েছি মেনে
এখন আমি মুচি হানিফ এই নামে, এ প্রজন্ম চেনে!
মুক্তিযুদ্ধের কথা এখন আর, আনি না এই মুখে
স্বাধীনতা বিরোধীরা, আছে অনেক সুখে!
হয়েছিলো কি মুক্তিযুদ্ধ সব গিয়েছি ভুলে
এসব কথা বলতে গেলে ফের যদি যাই জেলে?
রাজাকার হাশেমের ছেলেরা বড় বড় নেতা
তারা সবাই পায় এখন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা!
পিচ কমিটির ছেলে,
বড় নেতার সথে, তাঁরাই এখন চলে!
তাঁরাই করে বিচার শালিস
আগের রাতে টাকায় বিচার রফাদফা,
কেউ নাই শোনে ভুক্তভোগীর নালিশ!