মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন পলাশ
২৬ শে অক্টোবর ২০২৪ , চট্টল তত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিৎ লেখক ও গবেষক মরহুম আব্দুল হক চৌধুরী’র ৩০তম মৃত্যু বার্ষিকী, তিনি চট্টগ্রাম, সিলেট এবং আরাকানের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষনা করে এই খ্যাতি অর্জন করেন। ইতিহাসবিৎ হিসাবে তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হতে একুশে পদক লাভ করেন।
মরহুম আব্দুল হক চৌধুরী ১৯২২ সালের ২৪ শে আগষ্ট চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াজিষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম আলহাজ্ব মোহাম্মদ সরফুদ্দীন এবং তিনি থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রেঙ্গুঁন পোর্ট কমিশনে কর্মরত ছিলেন, জনাব চৌধুরীর মাতার নাম মোমেনা খাতুন চৌধুরী। তিনি বাড়ির পাশে নতুন হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন, পরবর্তীতে ডাবুয়া মধ্য ইংরেজি স্কুলে দু’বছর অধ্যায়ন করার পর তিনি ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রাউজান হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। পরবর্তীতে পিতা মোহাম্মদ সরফুদ্দীনের মৃত্যুর পর তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে। পরে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাবার প্রতিষ্ঠিত নোয়াজিষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসিক ১৫ টাকা বেতনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন এবং এ সময় তিনি জুবাইদা বানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিঁনি শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিঁনি সাত ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন।
প্রথীত যশা এই গবেষক “চন্দ্রাবতী” কাব্যের রচয়িতা কবি কোরেশী মাঘণ এর সপ্তম অর্ধতন পুরুষ। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস চর্চায় অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আমৃত্যু তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুগর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ কোনো ইতিহাস ছিল না, কিন্ত আব্দুল হক চৌধুরী প্রমাণ করেছিলেন চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন কালের ইতিহাস। ছোটবেলা থেকে পুঁথি সংগ্রহে তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। সেখান থেকেই মূলতঃ চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে তাঁর আগ্রহ শুরু হয়। জনাব চৌধুরী তার জন্মস্থান রাউজান ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা হাটহাজারী, ফটিকছড়ি অঞ্চল নিয়েও গবেষণা করেন । চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তির সব রকম উৎস তিনি তাঁর লেখার মাঝে তুলে ধরেছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রদান ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হয় এবং তাতে অংশগ্রহণ করার দায়ে ১৯৭১ সালের ১১ই আগষ্ট পাক বাহিনীর হাতে তিঁনি তাঁর তৃতীয় পুত্র সহ গ্রেফতার এবং নির্মম ভাবে নির্যাতিত হন। রাউজান থানায় ১৪৮/১৪৯/৩২৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। ২(৪)৭১ মামলা পরবর্তীতে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
আব্দুল হক চৌধুরী শিক্ষকতা ছেড়ে যখন ব্যবসা শুরু করেন তখন একই সঙ্গে তিঁনি বিদ্যা চর্চাও চালিয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা না থাকলেও আব্দুল হক চৌধুরী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় যে অবদান রাখেন তা রীতিমতা বিষ্ময়কর। রাউজান হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী শচন্দ্র চৌধুরীর প্রেরণায় তিনি প্রথম আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহিত হন। এ বিষয়ে তিনি চট্টগ্রামের অপর কৃতি সন্তান আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের নিকট থেকেও অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তারপর স্বীয় অঞ্চলের নশরত শাহের কোতোয়ালীর ধ্বংসাবশেষ, ঈসা খাঁ’র দীঘি, আরাকানি দূর্গাকোট এবং প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় বিভিন্ন পুরাকীর্তী তাকে এ সম্পর্কে আরো কৌতূহলী করে তোলেন।
আব্দুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম সিলেট আরাকান ও ত্রিপুরার সামাজিক নৃতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন তাঁর ভিত্তিতে উক্ত অঞ্চলের ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়ে আব্দুল হক চৌধুরীর রচিত মোট ১১ টি গ্রন্থ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রুপরেখা, চট্টগ্রাম আরাকান অধিবাসী প্রভৃতি, এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম চৌধুরী যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্ভবতঃ তখনই আব্দুল হক চৌধুরীর লিখিত চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। আব্দুল হক চৌধুরীর এক ছেলে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তাঁর মাধ্যমে আব্দুল হক চৌধুরীর সাথে ডঃ আব্দুল করিম সাহেবের সাথে যোগাযোগ এবং পরিচয় হয়। সেই পরিচয় যা আমরণ অটুট ছিল, ইতিহাসের যে কোনো সমস্যা নিয়ে জনাব চৌধুরী ডঃ করিমের সাথে অকপটে আলোচনা করতেন, চট্টগ্রামের সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে আব্দুল হক চৌধুরীর জুড়ি নেই।
আব্দুল হক চৌধুরী বড় লোকের সন্তান ছিলেন। আমার জানামতে পৈতৃক সম্পদের উপর ভর করে তিনি স্বচ্ছল ভাবে চলাফেরা করতেন এবং চট্রগ্রাম শহরের দেওয়ান বাজার এলাকার পূর্বদিকে তাঁদের একটি বহুতল বাড়ি রয়েছে।
মরহুম আব্দুল হক চৌধুরীর কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়ি রাউজান থানার নোয়াজিষপুর গ্রামে মরহুম আব্দুল হক চৌধুরীর নামে স্মৃতি কেন্দ্র ও সংগ্রহ শালা স্থাপন করা হয়। চট্রগ্রাম সহ তিনটি জেলার দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তৎকালীন সরকার এই বরেণ্য ব্যক্তির স্মরণে স্মৃতি কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা স্থাপন করেন। জনাব চৌধুরীর পরিবারের পক্ষে তাঁর ছেলে মনজুর উল আমিন চৌধুরী ২৬ শতক জমি দিয়েছিলেন সেই জমিতে ২০১৮ সালের ৩০ শে অক্টোবর আব্দুল হক চৌধুরী স্মৃতি কেন্দ্র ও সংগ্রহ শালার কাজ শুরু হয়। বর্তমানে সেটা একটি পূর্ণাঙ্গ ভবনে রুপ লাভ করেন।
১৯৯৪ সালের ২৬ শে অক্টোবর রোজ বুধবার রাত সোয়া সাতটায় ৭২ বছর বয়সে ইতিহাসের সংরক্ষক ও ইতিহাসের বরপুত্র আব্দুল হক চৌধুরী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ২৭ শে অক্টোবর গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবর স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর সম্পূর্ন কর্মময় জীবনের ইতিহাস এখনও সকলের মাঝে বিরাজমান রয়েছে।
লেখক- মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন পলাশ, উপদেষ্টা, কলম একাডেমি লন্ডন, সংযুক্ত আরব আমিরাত।