এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী
বহুদিন হল হয় না বাড়ি যাওয়া। দুঃখিনী মায়ের পথ চেয়ে থাকা, কখন খোকা আসবে বাড়ি। অপেক্ষিত ছোট ভাই বোন। অনেকদিন হয়, বড় ভাইকে দেখি না। ভাইয়া বাড়িতে আসবে, সবাই মিলে আনন্দ করবে। ভাইয়া ছাড়া পরিবারের সকল আনন্দই যেন অপূর্ণ। এসব কিছুই লেখা ছিল চিঠিতে। খোকার পরীক্ষা চলমান। মায়ের চিঠি পড়ে,খোকার চোখে অশ্রু টলমল করছে। কারণ বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা কার নেই, মায়ের মুখ, ছোট ভাই বোনদের আনন্দ। সবাইতো চায় পরিবারের সাথে, জীবনের কিছু বিশেষ মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে। চিঠি লেখা শুরু করলো খোকা। পরীক্ষা শেষেই, বাড়িতে যাবে। চিন্তা করো না মা, আমি ভালো আছি। আমার সালাম নিও, ছোট ভাইবোনদের আমার স্নেহ দিয়ে। বাবা কে আমার সালাম দিও। অনেকদিন হয় তোমার হাতের পিঠা খাই না। তোমার চাঁদমুখ দেখি না। তোমার মুখের হাসি, আমার কাছে স্বর্গ সমতুল্য। ছোট ভাই বোনদের আনন্দ, আমার কাছে পৃথিবীর সকল আনন্দের সমতুল্য। শীঘ্রই বাড়িতে আসবো। দেখা হবে তোমাদের সাথে। তোমার হাতের পিঠা খাবো। কিন্তু খোকা নিজেও জানত না, এটাই ছিল তার জীবনের শেষ দিন। খোকা নিজেও জানত না, যে চিঠিটা মায়ের জন্য লেখা হয়েছে। সেই চিঠিটা পাঠানোর পূর্বেই, শহীদ হয়ে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। মায়ের কাছে চিঠি নয়, যাবে তার লাশ। আর পকেটে থাকবে রক্তাক্ত চিঠি।মা কে লেখা চিঠিতে আবেগময় মনের ভাষা প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। হয়নি চিঠির ইতি টানা। হঠাৎ ডাক এসেছে, রাজপথে মিছিলে যেতে হবে। মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য, রাজপথে কঠিন লড়াই করতে হবে। অসমাপ্ত চিঠিটা বুক পকেটে রেখে দিল খোকা। রাজপথে শুরু হল দাওয়া পালটা দাওয়া। একদিকে নিরস্র ছাত্র জনতা ভাষার জন্য স্লোগান তুলছে, অন্যদিকে বাকশালীরা বুলেট ছুড়ছে। হঠাৎ একটি বুলেট এসে,খোকার বুকে লাগলো। হৃদপিণ্ড ছিদ্র করে বুলেট বেরিয়ে গেল। খোকা মা- মা- মা বলে মাটিতে লুকিয়ে পড়ল। পকেটে রাখা চিঠিটা, রক্তে লাল হয়ে গেল। অন্যদিকে দুঃখিনী মায়ের হৃদয় ছটফট করছে খোকার জন্য। কখন আসবে খোকা? আমার সোনা জাদু। কখন দেখব আমার কলিজার টুকরার চাঁদমুখ। অনেকদিন হয় নিজের হাতে কিছু খাওয়াতে পারিনা। প্রবাদ বাক্যে রয়েছে,
” সন্তানের যদি কিছু হয়, তাহলে পৃথিবীর সবার আগে মায়ের হৃদয় তা অনুভব করতে পারে”
ঠিক তেমনটি হয়েছিল খোকার মায়ের। একপর্যায়ে আন্দোলন শেষ হলো, মায়ের ভাষার বিজয় হলো।খোকার লাশ কফিনে করে,কয়েকজন বন্ধু মিলে কোকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হঠাৎ দুঃখিনী দেখতে পেল কারা যেন খোকার বাড়ির দিকে আসছে। কাঁধে রয়েছে একটি কফিন।দেখতে- দেখতে খোকার উঠুনে, কফিনটি নামালো। মায়ের হৃদয় শিহরিত হয়ে উঠলো। কাতর কন্ঠে খোকার মা জিজ্ঞেস করলো,তোমরা কারা বাবা? কেন এসেছো?আমার খোকা তো বাড়িতে নেই? তোমরা কুকার বন্ধু বুঝি?খোকা কি কোনো চিঠি পাঠিয়েছে? এই কফিনে কি রয়েছে?
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, কেউ কোন কথা বলতে চাইলো না। চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। অন্য দেখে মা আরো বেকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করছে। কি হয়েছে বাবা বলো? আমার খোকার কি কিছু হয়েছে? তোমরা কাঁদছো কেন? তোমাদের কেউ মারা গেছে? কিছু তো বলো?
হঠাৎ একজন একটি রক্তাক্ত চিঠি খোকার মায়ের হাতে দিলো।খোকার মা বলল, এটা কি বাবা?
এটাতে তো রক্ত লেগে আছে। কি আছে এটাতে। কেউ কোন জবাব দিচ্ছিল না। চিঠিটা খুলল, তাজা রক্ত ঝরছে চিঠি থেকে। কলমের কালি রূপান্তরিত হলে রক্তে। চিঠি কথা বলছে, মা আমি তোমার খোকা। ওরা আমাকে তোমার বুকে আসতে দেয়নি। মা আমার অনেক ইচ্ছা ছিল, তোমার হাতের পিঠা খাব। আর খাওয়া হলো না তোমার হাতের পিঠা।ওই নর পিচাশরা বুলেটের আঘাতে আমার হৃদয় থেকে আমার ভাষা কেড়ে নিয়েছে। আমি এখন শুধুই লাশ। তবে মা আমি শহীদ হয়েছি, বাংলা ভাষার জন্য। মা তুমি গর্বিত শহীদের মা। চিঠির লেখা দেখে, কফিনটা খুলে খোকার মুখটা দেখতে চাই গো মা। বন্ধুরা কফিনের ডালাটি খুলে দিল। খোকার গায়ে রক্তাক্ত জামা, মুখে মুচকি হাসি। মায়ের হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেলো।খোকা -খোকা বলে চিৎকার করে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাবা তুই একটা বার আমাকে মা বলে ডাক, আমি অনেকদিন হয় তোর মুখে মা ডাক শুনি না। উম্মাদের মত আচরণ মায়ের, বন্ধুরা সবাই স্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে রইল। শেষ হলো খোকার জীবনের গল্প, উম্মাদ হয়ে গেল খোকার মা। বিপ্লবের ইতিহাসে লেখা হলো খোকার নাম। চিরস্মরণীয় হয়ে রয়ে গেলো বাঙালির হৃদয়ে। একুশের চেতনা। একুশের ডায়েরি, আরও ভিন্ন নামে। এই ভাষা আমাদের প্রাণের চেয়েও দামি, রক্তের বিনিময়ে কেনা, বিপ্লবের প্রথম স্মৃতিচারণ। তাই আমরা সবাই এই ভাষাটাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।