হাফিজুল ইসলাম লস্কর, সিলেটঃ
সিলেটে নদী ভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে জকিগঞ্জে সুরমা- কুশিয়ারার ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় লক্ষ মানুষ, অস্তিত্ব হারাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। নদী ভাঙ্গনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী'র গর্ভে বিলীন হয়েছে হাটবাজার, ঘরবাড়ী, গাছপালা, জায়গাজমি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জকিগঞ্জের পুরো উপজেলার অর্ধশতাধিক স্থানে রয়েছে ভাঙ্গনের ভয়াল চিত্র।এভাবে নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে এক সময় জকিগঞ্জ শহর কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়ে যাবে।
শুধু তাই নয়, নদী ভাঙনের ফলে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ‘মানচিত্র। ভারতের বরাক নদী জকিগঞ্জের আমলশীদে এসে আন্তঃসীমান্ত সুরমা-কুশিয়ারা নদী দুটির উৎপত্তি হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর ৪১ কিলোমিটারই ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা। সীমান্ত আলাদা করে রাখা এ দুটি নদীর ভাঙন যেন থামছেই না। দিনদিন নিঃশব্দে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের হাজারো একর জায়গা। ফলে ‘সংকুচিত হচ্ছে’ দেশের মানচিত্র। দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত ভাঙনে এরই মধ্যে বাংলাদেশ- ভারতের ‘সীমানা পরিবর্তন’ হয়ে গেছে। নদী দুটি এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের বহু জমি ওপারের সীমানায় চলে গেছে। সেই জমি সেখানকার বাসিন্দারা ভোগ করছেন। গত কয়েক বছর থেকে আন্তঃসীমান্ত নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে শতশত একর জায়গা ও হাজারো পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এবার শুষ্ক মৌসুমে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জকিগঞ্জ পৌরসভার কেছরী, মাইজকান্দি, জকিগঞ্জ বাজার। খলাছড়া ইউপির ভুঁইয়ারমুড়া পশ্চিম লোহারমহল, কাপনা, গাগলাজুর, সুনাপুর। জকিগঞ্জ সদর ইউপির মানিকপুর, ভাখরশাল, শষ্যকুঁড়ি, সেনাপতিরচক, লালোগ্রাম। সুলতানপুর ইউপির খাদিমান, সুলতানপুর, ইছাপুর, খাদিমান, গঙ্গাজল, ভক্তিপুর, সহিদাবাদ, রহিমপুর। বারঠাকুরী ইউপির পিল্লাকান্দী, উত্তরকুল, লাড়িগ্রাম, আমলশীদ, বারঠাকুরী, বিন্নাপাড়া, ছালেহপুর। কসকনকপুর ইউপির বলরামেরচক, হাজিগঞ্জ, মুন্সিপাড়া, মিয়াগুল, চেকপোস্ট, মৌলভীরচক, বলরামেরচক, মিয়াগুল, বিয়াবাইল, ইনামতি, বিয়াবাইল। মানিকপুর ইউপির হরাইত্রিলোচন আকাশমল্লিক, বাল্লা, রঘুরচক। কাজলসা ইউপির নালুহাটি, বড়বন্দ, আটগ্রাম। বারহাল ইউপির চক, নিজগ্রাম, পুটিজুরি, শরীফাবাদ, শাহবাগ, বারইগ্রাম, চককোনাগ্রাম, নোয়াগ্রাম। বিরশ্রী ইউপির সোনাপুর, পিয়াইপুর, পীরনগর, লক্ষীবাজার, বড়চালিয়া, উজিরপুর, কোনাগ্রাম, মাজরগ্রাম, লাফাকোনা, বড়পাথর, জামডহর, সুপ্রাকান্দীতে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাঙনের কবলে রয়েছে। তাছাড়াও কিছু এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় পানির বিপৎসীমার নিচে নেমে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ উপচে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারতের উজানের ঢল বরাক নদী দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে ঢুকে। এরপর প্রায় ৭০ ভাগ পানি কুশিয়ারা ও ৩০ ভাগ পানি সুরমা দিয়ে সিলেট বিভাগের প্রায় ১০০টি নদ-নদীতে পানি প্রবাহিত হয়। বরাক নদীর পানি সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে আসার পরেই জকিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার নদীর বাঁধ ভেঙে এ উপজেলাসহ আশপাশের উপজেলা তলিয়ে যায়। আবার নদীর পানি কমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে বাঁধে ফাটল দেখা দিয়ে নদীতে ধসে পড়ে বাংলাদেশের জায়গা। এবারও শুষ্ক মৌসুমে নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তীরবর্তী প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। ইতোমধ্যে নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে সীমান্ত উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, জনপদ, কৃষিজমি, সড়কসহ অনেক অবকাঠামো, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর গোরস্থান। কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক-দুই কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। চলতি বছরে বরাক নদী থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে উজানের ঢল নেমে জকিগঞ্জে টানা চারবার বন্যা সৃষ্টি হয়েছে।
সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার বাসিন্দরা জানান, সুরমা-কুশিয়ারায় ভাঙন রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই অনেক বাড়িঘর, হাটবাজার, স্কুল, মসজিদ, রাস্তাঘাটসহ ফসলি জমি ঝুঁকিতে আছে। ভাঙন রোধের উদ্যোগ দ্রুত না নিলে হাজার হাজার একর জমি কয়েকদিনের মধ্যে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের ভূমি ভেঙে ভারতে চর জেগে ওঠছে। এই অবস্থা চলছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই। ভারতের করিমগঞ্জকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য ভারত সেদিকের তীরে শক্ত গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে বহুবছর আগে। এ কারণে নদীর প্রবল স্রোত এখন সরাসরি বাংলাদেশের তীরে আছড়ে পড়ে আমাদের ভূমি ধসে যায় নদীতে। এতে দিনদিন ভারতের অংশে বিশাল তীর জেগে ওঠতেছে। ভারতে সৃষ্টি হওয়া বিশাল তীরে সেদেশের লোকজন সারি সারি সুপারি গাছ ও বিভিন্ন জাতের কৃষিজাত পণ্যের চাষ করছেন। বিএসএফ নদীর তীরে বসিয়েছে চৌকি।
জকিগঞ্জ সদর ইউপির সদস্য ছবড়িয়া গ্রামের আব্দুল মুকিত বলেন, আমাদের গ্রামের বহু পরিবারের জায়গা ভারতে চলে গেছে। বসত ভিটাহীন মানুষজন এখন অন্যের জায়গার ওপর বসবাস করছেন। কেউ কেউ অন্যত্র সরে গেছেন। কুশিয়ারা নদীর বাঁক এখন ছবড়িয়া গ্রামের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। তবুও ভাঙন থামেনি। নদী ভাঙ্গনে ছবড়িয়া গ্রামের সৈয়দ আমিরুল ইসলাম মাদানী আল হুসাইনি রা. এর মাজার হুমকির মূখে রয়েছে। ভাঙন রোধের উদ্যোগ দ্রুত না নিলে তীরবর্তী অনেক গ্রামের অস্থিত্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে ভক্তিপুরে ৫০০ মিটার, মানিকপুর বাখরশালে ৮০০ মিটার, শষ্যকুঁড়িতে ৭০০ মিটার, শেখ পাড়ায় ২৫০ মিটার, উজিরপুরে ৪০০ মিটার, লক্ষীরারচকে ৫৫০ মিটার, সুনাপুরে ৪০০ মিটার, সুপ্রাকান্দিতে ৪০০ মিটার, গাগলাজুরে ২০০ মিটার, লোহার মহলে ৩৫০ মিটারসহ ১০টি স্থানে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ কি.মি। জকিগঞ্জ উপজেলায় ‘সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজে সুপ্রাকান্দি, মানিকপুর, রারাই সেনাপতির চক, বড়চালিয়া ও রহিমপুর নামক স্থানে ১ দশমিক ৮০০ কি.মি. নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। অপরটি চলমান। এ ছাড়া ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ার নদীর ডান তীরে ৪১ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুনর্বাসন কাজ ও অতি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধ ও বন্যা ঠেকাতে বেড়িবাঁধ নির্মাণে ইতোমধ্যে ৪৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায়। ভাঙন রোধের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখন কুশিয়ারা নদীর ছয় কিলোমিটার এলাকায় ব্লক বসাতে হবে। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। চলতি বছরের বন্যার পর নতুন করে কয়েক কিলোমিটার জায়গা সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, জকিগঞ্জের পরিস্থিতি আসলে খুবই ভয়াবহ। আমরা ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উচ্চমহলে অবগত করেছি।