জহিরুল ইসলাম ইসহাকী
টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এক মহাসম্মেলন শুরু হয়েছে। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছে লক্ষ লক্ষ মুসলমান। কেউ এসেছে আরব দেশ থেকে, কেউ ভারত-পাকিস্তান, কেউ ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া, কেউবা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। সকলের উদ্দেশ্য একটাই—আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করা, দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণ করা, এবং তাকওয়ায় নিজেকে পরিপূর্ণ করা।
তাবলিগ জামাতের এই বিশ্ব ইজতেমা আজ কেবল বাংলাদেশ নয়, বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের এক মহাসমাবেশে পরিণত হয়েছে। এখানে নেই কোনো বিভেদ, নেই কোনো রাজনৈতিক পরিচয়—সবাই এক, এক আল্লাহর বান্দা, এক নবীর উম্মত।
ধর্মীয় একতার সেতুবন্ধন
ইজতেমার ময়দান যেন এক ক্ষণস্থায়ী বিশ্ব—একটি মিনি উম্মাহ। সেখানে ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, পোশাক ভিন্ন, কিন্তু সবার অন্তর এক। সকলের কণ্ঠে একই ধ্বনি—
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ!”
টঙ্গীর এই পবিত্র ভূমিতে কোনো বিতর্ক নেই, নেই কোনো দলাদলি। এখানে একমাত্র পরিচয় হলো ইসলাম। ধনী-গরিব, রাজা-ফকির, সকলেই এক কাতারে বসে তাকরির শোনে, একসঙ্গে মাটিতে শোয়, একসঙ্গে আহার করে।
ইজতেমার মূল বার্তা
ইজতেমার প্রধান লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি ও দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ। এখানে মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়—
✅ ইমানের মজবুতি: আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা।
✅ নামাজের প্রতি গুরুত্ব: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকভাবে আদায় করা।
✅ সুন্দর আখলাক: উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য কুরআন-হাদিস অনুসরণ করা।
✅ দাওয়াত ও তাবলীগ: ইসলামের বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া।
✅ জিকির ও ইবাদত: আল্লাহর স্মরণ ও তাকওয়া অর্জনের অনুশীলন করা।
এই শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করাই ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য।
বিশ্ব মুসলিম মিলনের এক প্রতিচ্ছবি
টঙ্গীর ইজতেমা শুধু একটি জমায়েত নয়, এটি মুসলিম বিশ্বের এক অনন্য মিলনক্ষেত্র। এখানে তুরস্কের আলেমও আছেন, ইন্দোনেশিয়ার মুফতিও আছেন, আফ্রিকার দরবেশও আছেন, ইউরোপ-আমেরিকার নবমুসলিমও আছেন। সকলেই ইসলামের আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য এসেছেন।
এই ইজতেমা উম্মাহর ঐক্যের বার্তা বহন করে। পশ্চিমা বিশ্ব যখন ইসলামকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করছে, তখন টঙ্গীর ইজতেমা দেখিয়ে দেয় যে মুসলিম উম্মাহ আজও একতাবদ্ধ।
মুনাজাত: কান্নার সাগর
বিশ্ব ইজতেমার সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত হলো শেষ দিনের আখেরি মুনাজাত। লক্ষ লক্ষ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলে, চোখের পানি ঝরে পড়ে, আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে “আমিন আমিন” ধ্বনিতে। সবাই গুনাহ মাফ চায়, আল্লাহর পথে চলার সংকল্প করে।
“হে আল্লাহ! আমাদের হেদায়েত দাও, আমাদের গুনাহ মাফ করো, মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করো!”
এই দোয়ার মাধ্যমে নতুন এক আশার আলো জ্বলে ওঠে প্রতিটি হৃদয়ে।
উপসংহার
টঙ্গীর ময়দানে মুসলিম বিশ্বের এই মহামিলন এক নতুন পথের দিশা দেয়। এটি আমাদের শেখায় যে ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি এক বিশ্বজনীন জীবনব্যবস্থা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি, এক নবীর অনুসারী।
ইজতেমার শিক্ষা যেন শুধু তিন দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং এটি আমাদের সারাজীবনের পথনির্দেশক হয়ে ওঠে। টঙ্গীর ময়দানে উঠা তাকওয়ার বাতাস যেন ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীতে, আমীন!
“আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইজতেমার শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন!”