বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:০০ অপরাহ্ন

বাংলা ভাষার জন্য রক্তাক্ত ইতিহাস

Coder Boss
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ২৫ Time View

জহিরুল ইসলাম ইসহাকী
===============

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দিন, যেদিন মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত ঝরিয়েছিল বাঙালি জাতি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তা আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একুশের আত্মত্যাগের কারণে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত, যা বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য গৌরবের।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও ভাষা সংকট

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যার দুটি অংশ ছিল— পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান)। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত, কিন্তু তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ করাচিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। এই ঘোষণা বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ প্রথম ভাষা আন্দোলনের ধর্মঘট হয় এবং আন্দোলনের নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি: রক্তাক্ত অধ্যায়

১৯৫২ সালের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন ঘোষণা দেন যে, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা থাকবে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাঙালিরা আবারও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২১শে ফেব্রুয়ারি: শহীদের আত্মত্যাগ

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে, যাতে চারজনের বেশি লোক একসঙ্গে সমবেত হতে না পারে। কিন্তু ছাত্ররা তা মানেনি।

পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে শহীদ হন—

সালাম

রফিক

বরকত

জব্বার

এছাড়াও আরও অনেকে আহত হন।

এই ঘটনার পর পুরো পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ভাষা আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব

১. বাংলা ভাষার স্বীকৃতি

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

২. স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি

ভাষা আন্দোলনই পরবর্তীতে ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পথ তৈরি করে।

৩. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে। এটি বাঙালির জন্য এক অনন্য অর্জন।

উপসংহার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ভাষার অধিকারের লড়াই ছিল না, এটি ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বাররা রক্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি জীবন দিতে দ্বিধা করে না। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য শুধু শোকের দিন নয়, এটি গর্ব ও প্রেরণার দিন। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়াই হবে শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102