মনীষার ক্রমে ক্রমে বয়স হলো, এখন প্রায় সত্তরের কোটায়।ছেলে মেয়েরা যে যার মত প্রতিষ্ঠিত,কেউ বিশেষ সময় পায় না তাঁর কাছে আসতে। মাঝে মাঝে আসে, নিয়মিত ফোন করে -এটাকেই তিনি তাঁর বিশেষ পাওয়া বলে মনে করেন।স্বামীও নেই। এখন সুযোগ পেলেই তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়েন, বিশেষতঃ বাড়িতে দেবমূর্তির সামনে বসে আপনমনে নানা ভক্তিমূলক গান গেয়ে থাকেন।দিন তো শেষ হয়ে এলো,অলস সময়ে অতীতের নানা স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
চার বছর বয়সেই তাঁর মা তাঁর জন্য গানের দিদিমণি ঠিক করলেন, তাঁর কাছে গানের তালিম নেওয়া শুরু হলো।সবাই বলতো তাঁর গানের গলা বেশ সুন্দর।মাও পড়াশোনার পাশাপাশি গানের রেওয়াজেও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। একটু বড় হতেই তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখার জন্য গীতবিতান সঙ্গীত শিক্ষায়তনে ভর্তি হলেন, সেখান থেকে পরে ডিপ্লোমা নিয়ে পাশ করলেন।তারপর তাঁর নিজের গানের দিকে বিশেষ আগ্রহ থাকায় নানারকম গান শেখা শুরু করলেন প্রশিক্ষকের কাছে।ঠাকুরমা আগেকার দিনের লোক, প্রায়ই বলতেন মেয়েমানুষকে ওত পড়াশোনা আর গান শিখিয়ে কি হবে-সেই তো পরের ঘরে গিয়ে হাঁড়ি ঠেলবে! ছেলেমেয়েদের না হোক পড়াবে, কিন্তু গান কোন কাজে লাগবে বাপু?ও কি গাইয়ে বাজিয়ে হবে নাকি?এর চেয়ে সংসারের কাজ শিখুক,কাজে দেবে।মনীষার বেশ রাগ হতো, তবুও পড়াশোনা ও গানের চর্চা চালিয়ে যেতো।
যখন তার বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে এলো,তখন তার গান শুনতে চাইলো কয়েকটি -তারা আগ্রহভরে শুনে গানের প্রশংসা করেছিল। মনীষার মা বলেছিলেন দেখবেন আমার মেয়ের গান যেন বজায় থাকে। তারপর বিয়ের পরও আত্মীয়স্বজনেরা এলে তাঁর গান শুনে প্রশংসা করতেন। শ্বশুরবাড়িতে ক্রমে নানা কাজেই তার সময় কেটে যায়, গানের রেওয়াজ করা কমে গেছে।তবু সুযোগ পেলেই তিনি তানপুরা নিয়ে বসতেন।ক্রমে শাশুড়ি বলতে লাগলেন শ্বশুরবাড়িতে অনেক কাজ আছে বৌমা,ওসব গান টান নিয়ে বসা যাবে না-আগে তো কাজগুলি শেষ করো।সত্যিই তো সংসারে মেলা কাজ পরে আছে-এখন কি আর গান গাইলে চলে?ক্রমে তাঁর ছেলে মেয়ে হলো,গান নিয়ে বসাটাই তিনি একেবারে ভুলে গেলেন। খাটের তলায় থাকা হারমোনিয়াম আর তানপুরায় স্তরে স্তরে ধুলার আস্তরণ ঘন হতে লাগলো।কেউ আর তাঁর গান শুনতে চায় না।
স্বামী আবার ইংরাজি ও হিন্দি গানের ভক্ত, স্ত্রীর এসব গান পছন্দ করেন না,এসব নাকি সময়ের অপচয়!একসময় তিনি যে গান গাইতে জানেন,সেটাই ভুলে যেতে শুরু করলেন।ঐ কাজের ফাঁকে কখনো গুনগুন করেন,কখনো মাইকে গান বাজলে শোনেন এই অবধি। শাশুড়ি বলেন ওসব গান গেয়ে কি হয়-ওসব থেকে রোজগার হয় নাকি! এভাবেই তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভার অপমৃত্যু হলো।তিনি বুঝলেন তিনি তো আর অর্থ উপার্জন করতে পারেন না,তাই তাঁর গুণের কোনো মূল্য নেই। গৃহবধূর আর গুণ কী?
আজ মনীষার অখণ্ড অবসর,গান ই তার সঙ্গী। আবার হারমোনিয়াম, তানপুরা সারিয়েছেন,আপন মনে গান গেয়ে থাকেন, মানুষ নাই বা তাঁর গান শুনলো। টিভিতে গানের রিয়েলিটি শো দেখতে দেখতে ভাবেন আমি যদি এইরকম সুযোগ পেতাম! মানুষের কাছে না হোক অবহেলাই পেলেন,স্রষ্টা তো শুনছেন।তাই চোখের জল মুছে তিনি গান ধরলেন-
“আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া,ঘুরি আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া,
আমি দেখি নাই কিছু,বুঝি নাই কিছু,দাও হে দেখায়ে,বুঝায়ে।”