কলমে: সাহেলা সার্মিন
দায়িত্ব বলতে বোঝায় কোনো কাজ সম্পন্ন করার দায় বোধ। কারো প্রতি কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য যে ভার ন্যস্ত করা হয় বা কোনো কাজের প্রতি কোনো বোধ জন্মায় সেই দায়বোধকেই দায়িত্ব বলা হয়। সহজ করে বলা যায়, দায়িত্ব হলো কোনো অধস্তনের ওপর অর্পিত কার্য সম্পাদনের বাধ্য বাদকতা।
বার্টল এবং মার্টিন এর মতে, ” দায়িত্ব বলতে বোঝায় পদ অনুযায়ী লক্ষ্য অর্জনের দায়”
এস পি রবিন্স এবং কলটার বলেছেন, ” অর্পিত কার্যাবলি সম্পাদন করার বাধ্যবাদকতাকে দায়িত্ব বলে।”
কিন্তু সাংসারিক দায়িত্ব? সেখানে কী দায়বদ্ধতা আছে? হুম, কারো কারো আছে। সংসারের বড় সন্তান কখনো কখনো মা-বাবার অন্তিম শয্যায় ওয়াদা বদ্ধ হন। কেউ কেউ দায়িত্ব বোধ থেকে সংসার এবং ছোট ভাই-বোনের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।
দায়িত্বের সাথে আরেকটি শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা হচ্ছে কর্তব্য। কর্তব্য কী? অধিকার ভোগ করতে গিয়ে যে দায়িত্ব পালন করা হয় তাকে কর্তব্য বলে। এখন আসি সংসারের বড় ছেলে ইচ্ছা অনিচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে কিন্তু অধিকার কী ভোগ করতে পারে?পারে, যতোদিন ছোট ভাই-বোন এবং সংসার নড়বড়ে থাকে। নিজের সর্বস্ব অর্থ, সময় এবং ভালোবাসার বিনিময়ে যে বড় ভাই সংসারের হাল ধরে ছোটো ভাই-বোনকে লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বোনের বিয়ে দিয়েছে; সেদিনই অধিকারের অপমৃত্যু হয়েছে।
দায়িত্ব আর কর্তব্য যুগ যুগ ধরে শুধু বড় ভাইয়েরাই পালন করে আসছে। অথচ ছোটদের ওপর এদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই। এরা যখন অর্থ এবং শক্তিতে সাবলম্বী হয় তখন তারা বড় ভাইয়ের ত্যাগ সম্পূর্ণ ভুলে যায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে বলে, এটা তার দায়িত্ব ছিলো। সব বড় ভাই এটা করে, আমি বড় হলেও করতাম।
শুধু কথা নয়, তাদের আচার আচরণে বিতৃষ্ণা, দুরদুর স্বভাব, এমন কী কেউ কেউ বাড়ি থেকে বেরও করে দেয়। এমন নজিরের অভাব নেই ছোটদের মানুষ করতে যেয়ে বড়রা যখন সর্বস্ব হারায়, এমনকি নিজের শক্তিটুকু পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে যায় তখন তার কোনো মূল্য থাকে না।
আমার পরিচিত এক ব্যক্তি পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বড়। কৃষি তান্ত্রিক পরিবার ছিলো, জায়গা জমি ছিলো প্রচুর।কিন্তু অর্থ উপার্জন করতেন শুধু তিনি নিজে। তার উপার্জনের টাকা দিয়ে প্রতি বছর জমি কিনতেন সবার নামে। দু’বোনকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ভাইকে বি এ পাস করিয়েছেন সেই ১৯৬৫ সালের দিকে।নিজের টাকা এবং হাড়ভাংগা পরিশ্রম করে তাকে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন তিনি। তার লেখা পড়া করার সময় পঞ্চাশ টাকা চাইলে একশ টাকা দিতেন। নতুন কাপড়চোপড় ভাইকে দিয়ে পড়িয়ে নিজে পুরোনোগুলো পড়তেন। ছোটো ভাইকে আবার নতুন কিনে দিতেন। সেই ভাই তার আই সি ইউ থেকে মৃতদেহটা ছাড়িয়ে আনার জন্য ঘাটতি পড়া কিছু টাকা ধার চাইলে নাই বলে দূরে সরে দাঁড়ায়।
আমার মামাতো বোনের বর সৌদি কাটিয়েছন দীর্ঘ বছর। সেখান থেকে টাকা কামিয়ে ভাইয়ের ঠিকানায় পাঠাতেন। বলেছিলেন ঢাকায় একটু জায়গা কিনে দিতে। নব্বই দশকের কথা। মতিঝিলে চার কাঠা জায়গা কিনে ভাইকে বললেন সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে। তিনি বললেন আমি সামনে মাসে এসে বাকি টাকা পরিশোধ করে রেজিষ্ট্রি করে নেবো। দেশে এসে দেখলেন, তার ভাই সম্পূর্ণ জায়গা নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছে। তখন তার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে বলুন! প্রায় আধা পাগল হয়ে তার বৌকে নিয়ে চলে গেলেন সৌদি।
সেদিন ফেজবুকে দেখলাম এমনি একটি ঘটনা। এক ব্যক্তি দেশে কোনো একটা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বেশ টাকা কামিয়েছেন। দুটো ফ্ল্যাট কিনেছেন, একটি বৌয়ের নামে আরেকটি মায়ের নামে। তারপর চাকরি সূত্রেই সে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। তিন বছর পর দেশে এলে তার স্ত্রী বাসায় ঢুকতে দেয়নি। পরে মায়ের ফ্ল্যাট থেকেও তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ মায়ের ফ্ল্যাটটা তার ছোট ভাইকে লিখে দিয়েছে। আর তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। যাদের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে সুদূর বিদেশে থেকে এলেও কেউ তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়নি, বরং দুরদুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। অগত্যা পনেরোদিন হোটেলে থেকে চোখ ভরা জল নিয়ে আবার বিদেশে চলে যায়।
কেউ কেউ তার মায়ের মৃত্যু শয্যায় তার বিছানায় বসে ব্যবসা বানিজ্যের লাভ লোকসানের হিসাব করে, আবার কোনো সন্তান মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে দু’শ মাইল দূর থেকে যেয়ে তাকে এনে রাজধানীর বড় হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। দিন-রাত পরিশ্রম করে তাকে সুস্থ করে তুলেন।
আসলে দায়িত্ব বোধ সবার সমান নয়। বাবা, মার কাজ, মায়া মমতা, প্রচেষ্টা বড়ই থ্যাংকসলেস জব। না দেয়া যায় হিসাব, না জানে সন্তানদের সংসারে বউ বাচ্চা বা পরবর্তী প্রজন্ম। মনে কষ্ট নিয়েই এদের সময় পার করতে হয় এবং চোখের জলে ভেজা বুক নিয়েই নশ্বর দুনিয়া ছাড়তে হয়।