বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ অপরাহ্ন

ছোটগল্প: মধুমিয়া

Coder Boss
  • Update Time : রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১২৭ Time View

লেখক: মোহাম্মদ ইব্রাহীম মুন্সী

মধুমিয়া, বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই, মুখে কালো সাদা মিশ্র লম্বা দাঁড়ি, আমার সাথে পরিচয় ২০০৬ সনে, তখনো চিঠির যুগ বলা যায়, এখানকার মত সর্বজনের কাছে মোবাইল ফোন ছিল না, প্রবাসীরা তখনো চিঠি নিয়মিত পাঠাতো, আমিও ২০০৬/৭ নিয়মিত চিঠি পাঠিয়েছি দেশে, এ চিঠি লেখার সুবাদে মধুমিয়ার সাথে আমার পরিচয়, উনি শিক্ষিত নয়, দেশ থেকে চিঠি আসলে পড়িয়ে শুনাইতাম, সে চিঠির জবাবটাও আমি লিখেছি নিয়মিত, খুব স্নেহ করতেন আমাকে।
মধুমিয়ার জরাজীর্ণ শরীর, বয়স আর রোগ দুইটোতে হেরেগেছেন তিনি, মাঝেমধ্যে আমি বলতাম দাদা আর কত দেশে যাবেন না, এখন নাতি নাতনীনকে নিয়ে সময় কাটানোর বয়স আপনার, যখনি এ কথা টা বলতাম মুখে মলিন হাসি দেখেছি কিন্তু কখনো ওই জবাব পাইনি, (মাজরায়) বাগানে কাজ করেন আট শত রিয়াল বেতন মাসিক,( কপিল) মালিক বলেন( ইয়া আম্মি,আঁনা এহতারাম মিন আন্তা,আন্তা আলহীন সেহবা মাই একধার সোগল,আঁনা মাপি পায়দা,আঁনা মাই এবগা আন্তা ঝালান,আন্তা আইওয়াক্ত কাল্লাম এমসি বালাত আঁনা চোই ইজাজা,আন্তা রোহ বালাত সুপ ফি মুশকিলা তাল,মাপি মুশকিলা,আন্তা মুকসুদ আলহামদুলিল্লাহ্‌) এর অর্থ চাচা আপনাকে আমি সম্মান করি কিন্তু আপনি এখন বৃদ্ধ, আপনাকে দিয়ে আমার কাজ হয় না, আমি চাই না আপনি আমার উপর নারাজ বা রাগ করেন, আপনি যখনি বলবেন দেশে যাবেন আমি ছুটি লাগিয়ে দেব দেশে গিয়ে যদি সমস্যা দেখেন আবার চলে আসবেন আর যদি খুশি থাকেন আলহামদুলিল্লাহ্‌ মধুমিয়া রোগা শরীর নিয়েও কাজ করে চলছেন।
মধুমিয়ার তিন ছেলে তিন মেয়ে, ছেলে মেয়ে সবার বিয়ে সম্পুর্ণ করেছেন মোটামুটি সবাই সংসার গুছিয়েছে, মধুমিয়ার স্ত্রীও বেশ বয়স ষাঁড় পার করেছেন, এ বয়সে শরীরে যে অবস্থায় থাকার কথা তাই আছেন নায় -নাতনীনদের নিয়ে ভালো বলা যায়।
মধুমিয়ার দেশে যাওয়ার বিষয় কথা বলতেই আমার সাথে রেগে গেলেন বললেনঃ তুই সব চিঠি পড়ে শুনাস এমন কোনো একটা চিঠিতে লিখেছে আমাকে দেশে যেতে, ছেলে মেয়ে যে চিঠি দিয়েছে তাদের সমস্যা ছাড়া আর কি লেখে, আমার কি ইচ্ছে করে না দেশে যেতে আর পারছি না, আমার শেষ ইচ্ছাটা মরার আগে যেন দেশে যেতে পারি আল্লাহপাকের কাছে এ দোয়া করি।
২০০৭ শুক্রবার বিকাল বেলায় চলে আসলেন আমার কাছে আজ মুখ বর্তি হাসি বুঝা যাচ্ছে ভালো কোনো খবর আমি বললাম আজ খুশিখুশি লাগছে মনে হয়, এ শুনে শব্দ করে হেসে বললো হ্যা আমি দেশে যাবো আমার (কপিল) মালিক ছুটি লাগিয়ে পাসপোর্ট টিকেট দিয়েছে এ শুনে আমার কাছেও বেশ আনন্দ লাগলো মধুমিয়াকে অভিনন্দন জানালাম, এরপর আমাকে বললোঃ তোর বাসায় আমি কয়েকদিন থাকবো আমি জবাবে বললাম কয়েকদিন কেন কয়েকমাস থাকেন আমার কোনো সমস্যা নেই।
পরদিন থেকে মধুমিয়া খুশিমনে কেনাকাটা করতে লাগলেন এক এক করে সবার জন্য কিনলেন আমি সবটাই দেখেছি নিজে কাটুন করে দিয়েছি।
একটা নতুন বিটকের্স নিলেন আমি মজা করে বললাম দেশে গিয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে আছে কি না এ শুনে মৃদু হাসলেন কিছুই বললেন না, তখন প্রবাসীরা দেশে যাওয়ার সময় একটা বিটকের্স নিয়ে যেতেন, এখন আর বিটকের্স নিয়ে যান না কেউ এখন সবাই টলি ব্যাগ নিয়ে যায়।
এর পরদিন মধুমিয়া (মাজরায়) বাগানে গিয়ে তার পুরানা কাপড় জুতা সব নিয়ে আসলেন যা পড়ে কাজ করতেন তিনি এসব নিয়ে এসে খুব সুন্দর করে বিটকেস এ রাখলেন এ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম এসব কেন, না জবাব দিলেন না মৃদু হাসলেন আমিও আর জানতে চাইলাম না আমার কাছে এক সপ্তাহ ছিলেন ছেলে মেয়ে বা স্ত্রীর বিষয় কিছুই বলতেন না এ একটা সপ্তাহ উনাকে খুশিমনে দেখেছি।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশে গিয়েছে মধুমিয়া, খবরাখবর নেওয়ার সুযোগ হয়নি দেখতে দেখতে ছয় মাস পেরিয়েছে মধুমিয়ার কথা আমিও প্রায় ভুলে গিয়েছি প্রবাস জীবন নিজ কর্মে ব্যস্ততা প্রবাস জীবনটাই এমন কত মুখ দেখেছি কেউ কেউ এমন পরম বন্ধু হয় যেন রক্তের সম্পর্ক তার সাথে সেও একসময় চলে যায় আবার নতুন কোনো বন্ধু হয়।
ছয়মাস পর মধুমিয়ার এলাকার এক ব্যক্তি সৌদিআরব আসলেন তার সাথে পরিচয় হলো কথায় কথায় জানতে পারলাম মধুমিয়া তার পাশের বাড়ির শুনে খুব খুশিমনে মধুমিয়ার বিষয় জানতে চাইলাম বুঝতে পারিনি আমার খুশিমন ব্যতীত হবে, মধুমিয়া দেশে যাওয়ার চারমাস পর মৃত্যুবরণ করেন এ শুনে খুব ব্যতীত হলাম, যাইহোক এভাবে একদিন আমাদেরও বিদায় নিতে হবে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।
মধুমিয়ার নতুন বিটকেস এ পুরানা কাপড়, জুতা রাখার কারণ জানতে পারলাম, মানুষটা জানতেন দেশে যাওয়ার পর তার সন্তানরা তার দেখাশোনা করবে না, তারা বাবাকে টাকার জন্যই বাবা ডাকতেন, তার স্বাক্ষী আমি তাদের দেওয়া প্রতিটা চিঠি পড়েছি জবাব লেখেছি, মধুমিয়া শেষ সময় একটু সেবার জন্য এ অভিনব পথ বেছে নিতে হলো তিনি দেশে যাওয়ার পর বিটকেসে কি আছে কাউকে দেখাননি বলেননি তার স্ত্রীকেও, মাঝেমাঝে বিটকেস খুলে দেখতেন কাউকে আসতে দেখলে বন্ধ করে চাবি লুকিয়ে পেলতেন, সন্তানদের ধারণা ছিল এ বিটকেসে টাকা সোনা অনেক কিছু আছে এ ভেবে মধুমিয়ার সেবায় সবাই তুলকালাম, তারা ভেবেছে মধুমিয়াকে খুশি করতে পারলে বিটকেসে যাহা কিছু আছে সব দিয়ে দেবেন মধুমিয়া যখন যাহা খেতে ইচ্ছে করছেন তাই নিয়ে আসছে সন্তানরা।
মধুমিয়ার মৃত্যুরদিন তাকে দাফন না করেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিটকেস নিয়ে তালা বন্ধ বিটকেস চাবি লুকানো বিটকেস খুলতে বড়ই মুশকিল হয়ে পড়লো শেষ পর্যন্ত বিটকেস ভেঙ্গে যাহা দেখলো এ দেখার জন্য কেউ প্রস্তত ছিল না।
মধুমিয়া সন্তানদের কাছ থেকে একটু সেবা পেতে এমন অভিনব পথ বেছে নিয়েছেন, প্রতিটা প্রবাসীদের জীবনের গল্প এমন, প্রবাসীদের প্রতি পরিবার নির্ভরশীল হয়ে যায়, তখন পরিবারের সবাই এটা ভুলে যায় একজন প্রবাসী তাদের কাছ থেকে কি কি হারিয়েছে, আমি গত ১৫ বছরে ভুলে গিয়েছি তালের পিঠার স্বাদ, কাঠালের আঠা পরিষ্কার, বৃষ্টিতে ভেজা, কুয়াশা মাখা ভোর, কোকিলের ডাক বা পেঁচার রাঙা চোখ, তবুও বলবো ভালো থাকুক দেশ সুখে থাকুক পরিবার, ভালো থাকুক প্রতিটা প্রবাসী।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102