কৃষিবিদ কায়সার উদ্দিন আহমেদ।।
২০২৪ এর শুরুর দিকের কথা।
আমার বড় ছেলে যেহেতু নবম শ্রেণিতে উঠেছে, মেয়েটি চট্টগ্রাম কলেজ এ পড়ছে, ছোট টা হেফজ মাদ্রাসায় পড়ছে তাই ভবিষ্যতে ক্যারিয়ারের দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আমি আমার সহধর্মিণী সহ সন্তানদের নিয়ে বসি। আমি বলি তোরা বড় হচ্ছিস, বুঝতে শিখছিস, আমাদের গন্ডির বাহিরে গিয়ে নিজের মতো করে পৃথিবীটাকে দেখতে শুরু করছিস। নিজে থেকে অনেক সিদ্ধান্তও নিতে শুরু করছিস। ক্যারিয়ার ও টার্গেট নিয়ে তোদেরও দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি হচ্ছে। আমি শুধু আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও চাওয়াটা জানাতে চাই। আমি চাইনা তুই বুয়েটে পড়। আমি চাইনা তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে আমানুষ তৈরির কারখানায় পরিনত হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানে কোন মানবিক শিক্ষার বিকাশের কোন পরিবেশ নেই, যেখানে সামাজিক শিক্ষার কোন স্থান নেই, যেখানে নৈতিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয় সেই প্রতিষ্ঠানে আমার সন্তানের বেড়ে ওঠা আমি মেনে নিতে পারবো না। সামাজিক, নৈতিক বা মানবিক শিক্ষা কোন সিলেবাসে থাকে না। সে তার পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সমাজে সিলেবাসের শিক্ষার পাশাপাশি সামান গুরুত্ব দিয়ে শিখবে, জীবনে বাস্তবায়ন করবে। তারা শিখবে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কোন কাজটা নৈতিক আর কোন কাজটা অনৈতিক। যেখানে ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য একদল ছাত্রকে ভর্তি করা হয়, সেখানে যদি তারা তাদের সময় ব্যায় করে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কত? কয়টা স্প্যান আছে? এসব মুখস্থ করে, তাহলে আমাদের এই মেগা মেগা প্রকল্পগুলোর নকশা করবে কে? যেখানে কৃষিবিদ তৈরি করার কথা সেখানে সে বেশীরভাগ সময় ব্যায় করছে কোন দেশের রাজধানী কি, মুদ্রা কি? সর্বাত্মক শব্দের সঠিক প্রকৃতি প্রত্যয় কি? যখন তার বিষয় ভিত্তিক জটিল সমস্যা নিয়ে লাইব্রেরিতে সময় কাটানোর কথা তখন সে সমাধান করে অষ্টম বা নবম শ্রেণির গণিত বই। যে গনিত পড়ে এসএসসি পাশ করেছে বহু বছর আগে। যখন রিসার্স বা পাবলিকেশনে সময় দেওয়ার কথা তখন সে সময় দিচ্ছে বিসিএস বা ব্যাংক কোচিং এ। আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়গুলো নিরুৎসাহিত না করে সমর্থন করে গেছে। এর কারন হচ্ছে সরকারী চাকুরীতে ঘুষ দূর্ণীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ।
আমি দেখেছি আমার শিক্ষক, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সহ আশপাশের বেশীরভাগ মানুষ সব বিষয়ে এইসব ঘুষখোর, লোভী, দুর্ণীতিবাজদের বেশী গুরুত্ব দেয়। তাদের সংগ বেশী পছন্দ করে তাদেরকেই আত্মীয় বা কাছের লোক হিসেবে প্রকাশ করতে চায়। আর যারা মেধাভিত্তিক, শ্রমভিত্তিক পেশায় নৈতিকতা নিয়ে নিরলস ভাবে হালাল রুজির সংস্থান করছে, তাদের পাগল, বোকা, ব্যাকডেটেড ট্যাগ দিয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমি আমার সন্তানদের আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। বলি অনেক সময় দেখেছি অনেক কাছের লোকের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও আমাকে অনেক বার সম্মানের সহিত দাওয়াত দেওয়া হতোনা। সামাজিক সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধুদের মিলনমেলায় অংশগ্রহণও তেমন একটা কাংখিত থাকে নাই। এর পিছনে কারন হচ্ছে আমার অন্যায়ভাবে আয় করা অঠেল অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি না থাকা।
আমি জানি এই সমাজ, পরিবার ব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থা তোদেরকেও একই ভাবে গড়ে তুলবে। কিন্তু আমি চাইনা তোমরা এভাবে বেড়ে ওঠ। আমার বাবা অর্থাৎ তোদের দাদা ও চায়নি আমরা ভাই বোনরা এক ভাবে বেড়ে উঠি। আমি চেষ্টা করেছি নিজেকে মেধাভিত্তিক, শ্রমভিত্তিক হালাল রুজির মাধ্যমে পরিচালিত করতে। অনেক উচ্চ বেতনের বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি বাদ দিয়ে কৃষি কাজ করছি শুধুমাত্র আমার চিন্তা, স্বপ্ন ও আমার পৃথিবীটাকে আমি যেমন ভাবে দেখতে চাই সেটা আমার পেশায় বাস্তবায়ন করার তাগিদে। আমি সবসময় চেয়েছি আমি পরিবর্তন আনতে চাই। কিছুটা হলে ভিন্ন দৃষ্টিভংগির ছোয়া রাখতে চাই, এই সমাজ ব্যবস্থার, আমাদের চিন্তার ধরনে। আমার মেধা ও জ্ঞান, সময় এমন একটা কাজে ব্যায় করতে চেয়েছি যেটা আমাদের সকলের জন্য মংগলকর হবে। আমি হয়তো সেটা পারিনি কিন্তু আমার যায়গা থেকে আমার চেষ্টা অব্যহত রাখতে চাই। আমি বলবো না তোরা বিসিএস দিবি না, বড় বহুজাতিক কোম্পানির সিইও হবি না। অবশ্যই হবি।
কিন্তু সরকারী সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে সেবা দিচ্ছে, যেভাবে মানুষের পকেটের টাকা ছিনতাই করছে, যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, যেভাবে মানুষের হক নষ্ট করছে, এমন পরিস্থিতি যদি বিরাজমান থাকে তাহলে আমি চাইবো না আমার সন্তানরা নিজেদের এই পাপের সাগরে ভাসাক।
যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের লোভী করে তুলছে, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদেরকে নিষ্ঠুর করে তুলছে, যে শিক্ষা আমাদেরকে অন্যায় করতে উৎসাহিত করছে, আমি চাইনা তোরা সে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ কর। ***** বরং নিজেদের বিশ্বের ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগ্য করে তোল যেখানে শিক্ষার পরিবেশ আছে।
আমার এই দীর্ঘ বিবৃতির বিপরীতে আমার সহধর্মিণী কিছু বলল না। বুঝে নিয়েছি সহমত আছে। সে জমিদারের নাতি পুতি হলে ও তার ভিতরে জমিদারের অহংকার নিষ্টুরতা কখনো প্রকাশ পায় নি। অনেকের সাথে অনেক সময় আমার চিন্তাগুলো কিছু কিছু করে শেয়ার করেছি অনেকে নিরবে মাথা নেড়েছে আবার অনেকে পাগলের প্রলাপ ভেবে তাচ্ছিলের হাসি দিয়েছে।
আমি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছি, হলের ভিপি নির্বাচন ও কেন্দ্রীয় সংসদে নির্বাচনে লড়েছি। চেষ্টা করতাম মিছিল সমাবেশে সত্যের বানী উচ্চারণ করতে।
আজ আমি সকলকে প্রশ্ন করতে চাই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো কি তাদের উদ্যেশ্য পুরন করতে পারছে? এই অমানবিক, লোভী, অর্থলিপ্সু, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী তৈরির কারখানাগুলো কি এভাবেই চলবে?
দয়া করে কেউ বলবেন না গত ১৫/১৬/১৭ বছর কোথায় ছিলেন? আমাকে যারা জানেন তারা বলতে পারবেন আমি সোসাল মিডিয়ায় এতোটা এক্টিভ থাকার সময় পাই না। মাঝে মাঝে সময় বের করে আগে যে ভংগিতে লিখতাম এখনো সেই ভাবেই লিখছি। এক দুই মাস রাস্তায় মিছিল করে, সোস্যাল মিডিয়াকে প্রতিবাদের বন্যায় ভাসিয়ে, যারা দেড়/দুই যুগের হিসেব নিতে এসেছেন তারা দয়া করে এই পোস্টটা ignore করবেন।
****
আমার একটা স্বপ্ন আমার ছেলে মেয়েরা প্রচুর বই পড়বে, কোরানের তাফসির পড়বে, সাহিত্য, প্রবন্ধ, জার্নাল পড়বে, প্রচুর জ্ঞান আহরন করবে, নিজেকে সাহসী, দক্ষ, মানবিক, উদার, নিরাহংকারী, দানশীল পরোপকারী, দেশপ্রেমিক, নির্লোভ, খোদা ভীরু ও আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে।
মনে রাখবে আজকে যাদের কে ডেকে ডেকে সরকার বড় বড় পোষ্টে বসাচ্ছে তাঁরা ডায়মন্ড, ডায়মন্ড কাঁচের টুকরোর মতো এত সহজলভ্য নয়। খুঁজে খুঁজে আনতে হয়। হাজার লক্ষ বছরে মাটির নিচে কয়লা একদিন ডায়মন্ডে পরিনত হয়। সৎ পথে, জ্ঞানের পথে থেকে, যতই কষ্ট দুঃখ নির্যাতন আসবে ততই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে। এক সময় এটাই তোমার জীবনের যোগ্যতার মাপকাঠি হবে। জীবনে প্রচুর শ্রম সাধনা ত্যাগ করতে হবে তবেই জীবন কল্যাণময় ও আনন্দময় হবে।
*****
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, চিন্তা শক্তি বদলে যাচ্ছে, সামাজিক ধরন বদলে যাচ্ছে, পৃথিবীর ধরনটি বিজ্ঞান ময় হয়ে যাচ্ছে।।
লেখক:
বরেণ্য কৃষিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তা, মহেশখালী, কক্সবাজার।