মুহাম্মদ কাউছার আলম রবি
মা মরা মেয়ে ইচ্ছে। কোন এক বর্ষায় লালীর জন্য ঘাস লতাপাতা কাটতে গিয়ে কাল সাপের ধংশনে মায়ের শরীর নীলাভ হয়ে যায়। ওঝা বৈদ্যরা চেষ্টার কমতি না রাখলেও তিনি আর ফিরেন নি।
এক প্রকার ভালোই হলো, ভবঘুরে বাউন্ডলে স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি পেলো। অভাব অনটন, বাউন্ডলে স্বামী আর মেয়েদের নিয়ে চলছিলো ইচ্ছের মা ইলমার সংসার। মৃত্যু তাকে মুক্তি দিলেও মুক্তি দেয় নি ইচ্ছে কে।
ইতি কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাকে হারিয়েছে। বড় অভাগী বেচারি, জন্ম থেকেই পঙ্গুত্ব তার সঙ্গী। কি অপূর্ব দেখতে মেয়েটা, কন্ঠে অস্বাভাবিক সুর, চোখের চাহনিতে মায়া লেপ্টে থাকে! বড় বোন ইচ্ছে'ই আজ তাঁর একমাত্র অভিভাবক। মায়ের মৃত্যুর পর বাউন্ডলে বাবা যে ঘর ছেড়েছে আর ফিরে নি।
অগ্রহায়নের শেষে চারদিকে সকাল সন্ধ্যায় কুয়াশায় আছন্ন থাকে। পৌষ মাঘকে সাথে নিয়ে শীতকাল কড়া নাড়ছে। ইচ্ছে এ বাড়ি ওবাড়ির কাজ বাদ দিয়ে মুড়ি ভাজার কাজ পেয়েছে। শরলা দিদি তাকে কাজে নিয়েছে তার খাটুনি করার সক্ষমতা দেখে। দিনরাত মুড়ি ভেজে ইতির জন্য দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করে সে। মাঝেমধ্যে শরলা দিদি তাকে আধাপোড়া মুড়ি খেতে দিলে সেগুলোও বোনটার জন্য নিয়ে আসে। ইতি কে ছাড়া একটি দানাপানিও তার মুখে যায় না। যাবে কি করে, সে তো আজন্ম জননী হয়ে বসে আছে।
হঠাৎ একদিন তার উঁচু আসনটি থেকে দেখতে পেলো রোদেলা দুপুরে মিতু আর মীর মোড়া খাচ্ছে, সাথে খেজুরের পায়েসও। তাঁর খেতে খুব ইচ্ছে করলেও, চুপিসারে তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে ঘামাক্ত শরীর নিয়ে ঘরে এলে তার মোড়া ও খেজুরের পায়েস খাওয়ার ইচ্ছার কথা বলে। ইচ্ছে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে আশ্বস্ত করে। ইচ্ছের খুব সখ তার বোন অন্য মেয়েদের মতো হাঁটবে, খেলবে, দৌড়াবে। একদিন তাঁর সরু পায়ে শক্তি আসবে, শহরে নিয়ে চিকিৎসা করাবে। আরো কত সব ভাবনায় বিভোর ইচ্ছে, অথচ ঘাটে বসে এতসব ভাবতে ভাবতে তার গোসল ও খাওয়ার সময় ফুরিয়ে গেলো।
ইতির খুব সখ বোনের সাথে পাড়ায় ঘুরবে, মেলায় যাবে, এটা ওটা কিনবে কিন্তু কিছুই হয়ে উঠেনা। ভাগ্য তাকে সে সুযোগ দেয় না। পড়ে থাকে সারাদিন ঘরের উঁচু পাটাতনে। গতরে খাটতে খাটতে ইচ্ছেটাও কেমন যেন জীর্ন শীর্ণ হয়ে পড়েছে। বয়স আঠারোতে পৌঁছালেও দেহের চাপ যেন আশি ফিরিয়ে গেছে। হাজারো স্বপ্ন বুকে ধারণ করলেও তা পূরণ হয় না। চারদিকে পিঠাপুলির কত আয়োজন, অথচ সে একটি পিঠাও ছোট বোনটার হাতে তুলে দিতে পারেনি। আজ সাহস করে শরলা দিদির কাছে একটা পিঠা চাইবো, ইচ্ছে মনে মনে ভাবে।
মুড়ি ভাজা শেষে রসুইঘরে পিঠার দিকে তাকাতেই শরলার কত তির্যক কথা! পিঠা না চেয়ে, এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে ইচ্ছে ঘরে ফিরে আসে। চাপাকষ্ট কান্নায় পরিনত হয়ে বিষাদ বাষ্পীভূত হলেও ইচ্ছের ইচ্ছা পূরণ হয় নি। বোনকে মোড়া, খেজুরের পায়েস ও পিঠা খাওয়াবে আশ্বস্ত করায় আজ নিজেকে সে বড় অপরাধী মনে করছে। ইচ্ছের মলিন মুখে হাসি ফুটে না। দিনরাত এক করেও সে বোনের চিকিৎসা, খাওয়া জোগাড় করতে পারেনি। পারেনি মেলায় গিয়ে দু' মুষ্টি লাল চুড়ি কিনতে। ইচ্ছে যেন হাসতে ভুলে গেছে, সে কবে হেসেছে তাও জানা নেই তাঁর। এভাবেই দহনের বিষবাষ্প নিয়ে চলছে ইচ্ছেদের জীবন সংগ্রাম।