কলমে: মাকসুদা খাতুন দোলন
প্রায় প্রতিদিনই কিছুটা পথ বাসে কিছুটা হেঁটে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়ায় আলো। ভয়,ক্লান্তিতে ঘামের নোনাজলে শরীর ভেজা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে এসেম্বলি শেষ হয়ে যায়। শ্রেণিশিক্ষক কামরুনন্নেছা বেগম ছাত্রীদের নাম ডাকা শুরু করে প্রায় শেষের দিকে। তিনি আলোকে দেখে ভ্রু কুচকে রাখেন। আলো প্রায়ই দেরি করে স্কুলে আসে। বারবার সতর্ক করার পরও আলো ঠিক সময়মতো স্কুলে আসতে পারে না। কামরুনন্নেছা বেগম কড়া হলেও ছাত্রীদের সন্তানের চোখে দেখেন। নিজে মা হতে পারেন নি। আক্ষেপ,দীর্ঘশ্বাস থাকলেও স্কুলে এসে তার মন ভালো হয়ে যায়। সব ছাত্রীদের তিনি মেয়ে মনে করেন। লেখাপড়া করে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেন। শাসন করেন,পাশাপাশি মাতৃস্নেহে আদরও করেন। ওনি নাম ডাকা শেষ করে বিরক্তির রেশ নিয়ে গম্ভীর গলায় ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দেন।
‘এত দেরি কেন আলো? সবাই আসতে পারলে তোমার কি সমস্যা?’
আলো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে নির্ধারিত সিটে দুই বান্ধবীর সাথে বসে। ক্লাস চলাকালে ঝিমায়। অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কেন দেরি হচ্ছে,লেখাপড়ায় কেন অমনোযোগী বান্ধবীরা কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না চুপ করে থাকে। প্রাইভেটেও নিয়মিত যেতে পারে না। আলো মেধাবী ছাত্রী। ক্লাস ফাইভ,এইটে স্কলারশিপ পেয়েছে। ক্লাস নাইনে উঠার পর থেকে হঠাৎ আলোর জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
রাতে পড়া শেষ করে খেতে বসে আলো। সবার সাথে একসাথে খাওয়া হয় না। হয় তাকে আগে খেতে হয় না হয় সবার পরে খতে হয়। বেশিরভাগ সময় সবার খাওয়ার পর খেতে হয় কারণ এঁটো থালাবাসন ধুঁয়ে সব গুছিয়ে রান্নাঘর থেকে তাকে বের হতে হয়। শুক্রবার ছুটির দিন। শরাফত হোসেন বাজার থেকে বড় রুই মাছ এনে স্ত্রীকে বললেন,
‘জেবা মাছটা তাজা। নদীর মাছ। কয়েক টুকরা মাছ ভাজবা। আলু,বেগুন,টমেটো দিয়ে মাখামাখা ঝোলে রান্না করবা। সবাই একসাথে খাবো।’
আলো পাশের রুম থেকে শুনে খুব খুশি হয়। মাছ ভাঁজা তার খুব পছন্দের। মাছ ভাঁজা থাকলে তার অন্য কোনো তরকারি লাগে না। আলো তরকারি, মাছ কেটে ধুয়ে,সব রেডি করে মা’কে ডাক দিল।
জেবা ছোট বাচ্চাকে বুকের দুধ দিতে দিতে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিল। জেবা এসে তরকারি বসিয়ে আলোকে ভাত,ডাল,মাছ ভাঁজা করার কথা বলে আবার টিভির সামনে চলে গেল। সামনে আলোর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। কাজের চাপে ঠিকমতো লেখাপড়ায় মন দিতে পারে না। ভীষণ মন খারাপ থাকে,আড়ালে কাঁদে। কষ্ট চেপে রান্নার কাজ শেষ করে। দুপুরে সবাই খেতে বসে। শরাফত মেয়েকে ডাকছেন। ডাক শুনেই আলো পাটিতে বাবার পাশে বসে। জেবা রাগে বড় বড় চোখে তাকায় আলোর দিকে। খানিক সময় ভেবে বলল,
‘আলো যা আগে রাব্বিকে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে আয়। পরে ভাত খাবি।’
শরাফত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘না,আলো খাওয়া শেষ করে তারপর রাব্বিকে ঘুম আনাবে। তানি এখন খেতে পারলে আলোও খাবে।’
জেবা চোখ রাঙিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে খেকিয়ে বলল,
‘তুমি চুপ থাকো। ঘুম না আনালে রাব্বি বিরক্ত করবো। আমাকে ঘুমাইতে দিবে না। তানি ছোট। তানির সাথে আলোর তুলনা করছো কেন? আলোর বিয়ের বয়স হইছে। ওকে ঘর সংসারের দায়দায়িত্ব শিখতে হবে।’
বাবার সাথে মায়ের কথা কাটাকাটি,রাগারাগি হবে ভেবে আলো নিঃশব্দে উঠে যায়। রাব্বিকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরের বারান্দায় চলে আসে। ঘুরে ঘুরে ভাইকে ঘুম পাড়াচ্ছে। চাপা কষ্টগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জলে বিসর্জন দেয়। রাব্বিকে শুইয়ে দিয়ে খেতে বসে আলো। ঢাকনা তুলে কড়াইয়ের তলায় ভাঙা এক টুকরো মাছ দেখে চোখ ভিজে উঠে। মলিন মুখে মাছ ভাঁজা দিয়ে দুই লুকমা ভাত খাওয়ার পর তরকারির দিকে তাকায়। তরকারি দিয়ে খেতে ইচ্ছে করলো না। মাছ ভাঁজা দিয়েই ভাত খেতে ইচ্ছে করছে তার। খুঁজে আলাদা বাটিতে মাছ ভাঁজা তুলে রাখা দেখে একটা উঠাতেই জেবা পানি খেতে এসে দেখে ফেলল। সাথে সাথে মাছ বাটিতে রেখে দিল আলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল,
‘মা,তরকারি দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না।’
জেবা রাগে জ্বলে উঠে। চুলের মুঠি ধরে ঠাস ঠাস দুই চড় বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘মাছ চুরি করে খাস,বজ্জাতি করে আমার ছেলের দুধ পুইড়া ফেলিস আইজ তরেই আমি পুড়াবো।’
আলোকে হেঁচকা টান দিয়ে চুলার কাছে নিয়ে একহাতে মুখ চেপে অন্য হাত দিয়ে আলোর ভাত মাখা দুটো আঙ্গুল আগুনে ধরে রাখে। মুখ চেপে রাখাতে আলো গোঙাতে থাকে। শরীরের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে মা’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে উঠোনে চলে আসে আলো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আলো। জেবা সাপের মতো ফোসতে ফোসতে বলল,
‘যদি বাপের কাছে কিছু বলছোস বাপ বেটিরে একসাথে দুধে বিষ মিশায়ে খাওয়াবো।’
আলোর চোখে মায়ের মুখটি ভেসে উঠে। কতদিন মাছের কাটা বেছে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিয়েছে। মা চলে গেছে। এই মা যদি সত্যিই বাবাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তাহলে তার কেউ থাকবে না। ভয়ে কোনো কিছুই বাবাকে বলে না আলো। ক্লাসে পড়া দেখানোর সময় কামরুন্নেচ্ছার নজর গেল আলোর আঙ্গুলের দিকে।
‘আহা! আঙ্গুল পুড়লো কি করে?’
‘ভাত রান্না করতে গিয়ে।’ মিথ্যা কথা বলে আলো টলমল চোখে অন্যদিকে তাকায়। আপা আলোর ফুসকা পড়া পুড়া আঙ্গুল কয়েকবার দেখলেন।
‘সামনে পরীক্ষা। দেখেশুনে কাজ করতে হয় না?
মা কোথায় ছিলেন?’
‘ঘরেই ছিল।’
আলোর টলমল চোখ কামরুন্নেচ্ছার ভেতরে খুব নাড়া দিল। আলো কিছু এড়িয়ে যাচ্ছে আপা বুঝতে পারেন। বেশি কিছু জানতে না চেয়ে বললেন,
‘ছুটির পর দেখা করে যেও।’
ছুটির পর আলো আপার সাথে দেখা করলো না।
মায়ের ভয়ে নিজেদের কথা কারো কাছে বলে না।
দেখতে দেখতে আলো নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উঠে। টেস্ট পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। সামনে ফর্ম ফিলাপ। জেবা কিছুতেই আলোর ফরম ফিলাপের টাকা দিতে দেবে না। আলোর লেখাপড়ার দরকার নেই। বিয়ের প্রস্তাব আনে।
আলোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীকে চাপ দিতে থাকে। শরাফত হোসেন মেয়েকে বিয়ে দেবেন না।
স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যান। হসপিটালে নেওয়ার পথে শরাফত হোসেন মারা যান। বাবাকে হারিয়ে আলোর জীবন অন্ধকারে ঢেকে যায়। কোথায় যাবে? কার আছে থাকবে? সামনে এসএসসি পরীক্ষা। ফরম ফিলাপের টাকা দেবে কে? নানি গ্রামে থাকে মামাদের সাথে। মামার টানাটানির সংসার। নানিকে একবেলা খাবার দিয়ে মামি সব সময় দুই কথা শুনিয়ে দেন। জবা মামার কাছে ফরম ফিলাপের টাকার জন্য হাত পাতলো না। হঠাৎ মনে পড়ে সোনার বালা দুটোর কথা। যা যত্নে আগলে রেখেছিল। স্মৃতি নিয়ে ছুটে গেল কামরুন্নেচ্ছা আপার কাছে।
‘মিস,এই বালা দুটো আমার মায়ের। মা তো বেঁচে নেই! বালা দুটোকে আগলে রেখে শান্তি পেতাম। মনে হতো মা আমার সাথেই আছেন। নতুন মায়ের ভয়ে বালা দুটো লুকিয়ে রেখেছিলাম। বাবাও কিছুদিন আগে আমাকে একা করে চলে গেলেন। মিস আমি লেখাপড়া করতে চাই। এইগুলো আপনার কাছে রেখে আমাকে ফরম ফিলাপের টাকা দিন।’
কামরুন্নেচ্ছা বেগম থ হয়ে আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আলো এক এক করে তার জীবনের সব ঘটনা বলল। বালা দুটো হাতে নিয়ে আলোকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন,
‘মা তোর ছোট্ট জীবনে এতকিছু ঘটে গেল। একটাবার আমাকে বললি না। এতকিছু চেপে রাখছিস কি করে? এত ধৈর্য তোর?
তোর ফর্ম ফিলাপ হবে,লেখাপড়া চলবে। মাথা উঁচু করে বাঁচবি তুই। আমি আছি তোর পাশে।’
আলো মিসকে শক্ত করে জড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।
করিমনন্নেছা আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বালা দিয়ে বললেন,
‘তোর মায়ের স্মৃতি তোর সম্বল। আমার কাছে রাখার দরকার নাই। মানুষের পাশে যখন কেউ থাকে না,খুব অসহায় হয়ে পড়ে তখন সৃষ্টিকর্তাই
একমাত্র ভরসা। ওনি সবার উপরে সব সময় আছেন। আমার ঘরের দরজা তোর জন্য সব সময় খোলা।’
স্বামী মারা যাওয়ার পর ব্যাংকের সঞ্চিত টাকা,ভাইদের টুকটাক সহযোগিতায় জেবা সংসারের খরচ চালায়। আলো সৎ মায়ের সংসারে কাজের সাহায্যকারী হয়ে পড়ে রইলো। রান্নাবান্না,সংসারের কাজ,ছোট ভাইয়ের দেখভাল
সব আলোকেই করতে হয়। সামান্য ভুলে চলে নিরব নির্যাতন। সব সহ্য করে আলো এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে। জেবা তড়িগড়ি করে আলোর বিয়ে ঠিক করে সত্তর বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধার সাথে। বিয়ের কথা জেনে আলোর চোখ নোনাজলে ভিজে উঠে। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আলো চলে আসে কামরুন্নেচ্ছার বাড়িতে।
তিনি আলোকে দেখে হাসিমুখে বুকে জড়িয়ে নিলেন। এসএসসির রেজাল্ট হলো। তিন বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগ পেল।
শহরে সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগও পেয়ে গেল। লেখাপড়ার খরচের চিন্তা করে বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে আর্টস নিল। কামরুন্নেচ্ছা আপার স্বামীর কলিগের সহযোগিতায় হোস্টেলে সিট পেল আলো। শুরু হলো তার পড়াশোনার জীবন। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এই চিন্তা মাথায় সারাক্ষণ ঘুরে। হোস্টেল ডাইনিংয়ের আয়ার সহযোগিতায় কলেজের কাছেই একটা টিউশনি পেলো। ক্লাস টু’য়ের বাচ্চাকে পড়িয়ে যা পায় প্রয়োজনীয় টুকটাক খরচ চালিয়ে নিতে পারে। মিসের উপর সে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। আয়াকে বলল যে করেই হোক আর একটা টিউশনি যোগাড় করে দিতে। বন্ধের দিনগুলোতে আলো কামরুন্নেচ্ছার কাছে না গেলে ওনি নিজেই রান্না করে আলোকে দেখতে চলে আসে।
কেটে গেল দু’বছর। আলোর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। চলে আসে কামরুন্নেচ্ছার কাছে। ভর্তি কোচিং করবে টাকা পাবে কোথায়? নিজের ইচ্ছে চেপে রাখলো। মিসের মধ্যবিত্তের সংসারে নিজের খরচ আর বাড়াতে চাইলো না আলো। ভর্তির জন্য বাসায় লেখাপড়া করে মিসের কাজে সহযোগিতা করে। সময় ঘনিয়ে এল ভর্তি পরীক্ষার। চান্স পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটের ইংরেজি বিষয়ে। আলোর স্বপ্ন আরও একধাপ এগিয়ে গেল। কামরুন্নেচ্ছা খুশিতে আলোকে বুকে জড়িয়ে নেন।
‘তুই ও আমার সাবজেক্টে চান্স পেলি! গর্বে বুকটা ভরে উঠে। মরে রাখিস মা জীবনে বড় কিছু হতে হলে নিজের ইচ্ছে শক্তিটাই আসল। কেউ বিফলে যায় না যদি তার শতভাগ চেষ্টা থাকে। মানুষের চলার পথটা বন্ধুর। এত সহজে কিছু পাওয়া যায় না। সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়।’
কামরুন্নেচ্ছা আপার সহযোগিতায় আলো ঢাবিতে ভর্তি হলো । ক্লাশ,লাইব্রেরি শেষ করে রুমে আসে। রুমমেটদের সাথে কথা বলে বড় হয়ে কে কোন পেশায় যাবে। প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে। নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রতি মাসে মিসের কাছ থেকে সে আর টাকা চাইবে না। এক বন্ধু শফিকের মাধ্যমে জানতে পারে টিউশনির জন্য কোচিং সেন্টার আছে। আলো সেখানে সিভি দিয়ে আসে। দশদিন পরে একটা টিউশনি পেয়ে গেল। এরপর থেকে আলোকে মিসের কাছ থেকে কোনো টাকা আনতে হয়নি। লেখাপড়া,টিউশনির পাশাপাশি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আলো। বন্ধ পেলে মিসের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করে দুটো দিন থেকে আসে। কেটে গেল কয়েক বছর। আলোর অনার্স,মাস্টার্স শেষ হলো। সেকেন্ড ক্লাস পেলো।
কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে থেকে টিউশনি করে,
চাকরির লেখাপড়া করে। কামরুন্নেচ্ছা আপা অবসরে গেলেন। আলো লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করে । আগের মতো এখন আর ঘনঘন
মিসের কাছে যায় না। মায়ের কথা মনে পড়লে মিসের মুখ দেখার জন্য ছুটে যায় আলো। শুক্রবার এক বিকালে গিয়ে মিসকে পেলো না। জানতে পারলো তিনি স্বামীকে নিয়ে ভারত গেছেন চিকিৎসার জন্য। পেনশনের টাকা খরচ করে অনেক চেষ্টা করেও স্বামীকে ক্যান্সারের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। স্বামীকে হারিয়ে কামরুন্নেচ্ছা একা,নিঃসঙ্গ হয়ে যান। শহরে ভাড়া বাসায় থাকতে ইচ্ছে হলো না। চলে গেলেন গ্রামের বাড়ি।
দেখতে দেখতে অনেক সময় পার। আলোর মেধা,
পরিশ্রম,ধৈর্য,অধ্যবসায় কাঙ্খিত স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে দিল। প্রসাশন ক্যাডারে বিসিএসে এসিল্যান্ডে নিয়োগ পেল। ভেজা চোখ নিয়ে মা,বাবার কবরে আসে। দু’হাত তুলে মনের কথা বলে। মায়ের মতো যে তাকে আদরে,শাসনে, আশ্রয়ে,আগলে রেখেছিল ছুটে আসে মিসের ঠিকানায়। এসে দেখে নতুন ভাড়াটিয়া। ঠিকানা সংগ্রহ করে চলে আসে কামরুন্নেচ্ছা আপার গ্রামের বাড়ি। কামরুন্নেচ্ছা আপার চেহারার বয়সের ছাপ। শুকিয়ে অনেকটা রোগাটে হয়ে গেছেন। আলোকে দেখে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আলো মমতাময়ী মিসকে বুকে মিশিয়ে রাখে। আলোর দু’চোখ উপচে নোনাজল গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। নিঃশব্দে খানিকটা সময় চলে যায়। আলো কোনো কথা না বলে কামরুন্নেচ্ছার কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে বলল,
‘এখন যে সুখবরটা দেব তারজন্য আবার কাঁদবে।
আমার বিসিএসে চাকরি হয়েছে। এখন আর দু’জনকে আলাদা থাকতে হবে না। বাকিটা জীবন মা,মেয়ে একসাথে থাকবো। দেশের যে প্রান্তেই আমাকে পাঠাবে মা তুমিও থাকবে আমার সাথে।’
কামরুন্নেচ্ছা আবার অশ্রুসিক্ত হলেন সাথে আলোও।
জয়েনের প্রথম দিন আলো কামরুন্নেচ্ছাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে মায়ের বালা দুটো মিসকে পরিয়ে বলল,
‘জন্মদাত্রী মা’কে কোনোদিন ফিরে পাবো না । মায়ের স্নেহ,আশ্রয়ে আমাকে যে আগলে রেখেছিল,অন্ধকার জীবন থেকে আলোতে এনেছিল সেই আর্দশ শিক্ষকই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক,মমতাময়ী আমার মা। বালা দুটো তোমার হাতেই মানায় মা।’
কামরুন্নেচ্ছা বেগম চোখে শাড়ির আঁচল চেপে ফুপিয়ে কাঁদলেন। আলো মা’কে জড়িয়ে রাখলো কিছু সময়।………..