শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৭ অপরাহ্ন

বৃদ্ধাশ্রম এখন ব্যবসায় পরিনত

Coder Boss
  • Update Time : শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪
  • ২৯ Time View

মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ

মানুষের আদত গত স্বভাব হচ্ছে পুরোনো জিনিস পত্র যদি বাড়িতে থাকে তা না হয় পুরোনো ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে দেয়া; না হয় ময়লার ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া। পুরোনো জিনিস যেন মানুষের সহ্যই হয় না। দামি শহরে, দামি ফ্লাইট বাড়ি সেখানে কী আর জায়গা হবে পুরোনো মা-বাবার। দামি সোফা, দামি চেয়ারে শোভা পাচ্ছে ঘরের আঙিনা। কিন্তু সেই ফ্লাটের এককোণে জায়গা হয় না বুড়ো মা-বাবার। তাই এই শহরে লাভজনক ব্যবসা হয়ে ওঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। দিন বা দিন যে মানুষ দামি হচ্ছে, দামি হচ্ছে তার বাড়ি। নতুন নতুন কাস্টমার জুটছে ডিজিটাল ও স্মার্ট হয়ে ওটা ছেলেমেয়েদের বাড়ি গুলোতে সবচেয়ে কমদামী বস্তু দুইজন অভাগা মা-বাবার। দুখিনি মা দশ মাস গর্ভে ধারণ করে, পিতা ১৫-২০ বৎসর পরিশ্রম করে লালন-পালন করে বড়ো করে তুললেন। শেষ বয়সে তারা চায় একটু সন্তানের ভালোবাসা; শেষ বয়সে তাদের লাঠি হয়ে সন্তান পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়ে যাওয়ার পর আর বুড়ো মা-বাবার প্রয়োজন পরে না। সুন্দরী বধূ কে নিয়ে ঢাকার গুলশানে বা অভিজাত কোন দামি শহরে বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়িতে কী পুরোনো হয়ে যাওয়া বুড়ো মা-বাবাকে কি মানায়? বধূর যে সয় না বুড়ো জঞ্জাল মা-বাবাকে। তাই তো বুকের মানিক সাত রাজার ধন ছুড়ে ফলে দেয় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এ কারাগারে বন্দি হয়ে থাকতে হয়। এটাই কি ছিল তাদের শেষ জীবনের প্রাপ্য? এর জন্যই কি তারা কষ্ট করে সন্তানকে লালন-পালন করে বড়ো করে তুলেছেন? সন্তানের উচিত ছিল শেষ বয়সের তাদের হাতের লাঠি হওয়া। তাদের ভরসা ও প্রশান্তির চাবিকাঠি হওয়া। সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের দেখাশোনা করা। স্ত্রী, সন্তানদের জন্য যেভাবে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন করেন; ঠিক মা-বাবার জন্যই একটু করার চেষ্টা করবেন। ভুলে যাবেন না, তারা আপনাকে আপনার সন্তানদের মতো থাকতে এভাবে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন করে খায়িছে। নিজেরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রিযাপন করলেও আপনাকে কখনো ক্ষুধার্ত রাখেনি। সেই দুটি জড়বস্তুর নাম মা আর বাবা। পৃথিবীর বিশ্বস্ত দুইটি স্থান। সময়ের সাথে সাথে যেন এ সম্পর্ক গুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে? মা-বাবার সাথে সন্তানদের তেমন আগের মতো সেই সম্পর্কটা নেই। সময়ের পালা বদলে হারিয়ে যাচ্ছে; সম্পর্কের নিখুঁত ভরসার স্থান গুলো। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায়; উচ্চশিক্ষিত পরিবার। শিক্ষার ভারে তারা একে অপরের কাছে বসার সময়ই পায় না। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সময় পার হয়ে যায়। বুড়ো মা-বাবাকে সময় দেয়ার ফুরসত কেই! মা-বাবা আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তিন ইঞ্চির পৃথিবীর মধ্যে বুদ হয়ে থাকে। সন্তানদের দেখাশোনা করার মতো তাদের সময় হয় না। তাদের দেখাশোনা করতে আয়া বা বোয়ার প্রয়োজন পরে। সেই সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়ে মা-বাবাকে আর তার ভালো লাগে না; মনে হয় যেন তারা বাড়ির সবচেয়ে নোংরা বস্তু। বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলেই বাঁচি। মা-বাবা সন্তানদের হক বা অধিকার আদায় করছেন না; সেই সন্তানদের কাছে কীভাবে আশা করেন তারা আপনাদের হক বা অধিকার আদায় করবে? ইসলাম প্রথমে পিতা-মাতাকে সন্তানদের হক আদায়ের কথা বলেছে; তারপর সন্তান আপনার বৃদ্ধ বয়সে হক আদায় করবে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন,
وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُلۡ رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا ﴿ؕ۲۴﴾
“আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন; যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।” (সুরা বনি ইসরাইল:২৪)
সন্তান কখন পিতা-মাতার জন্য কি করবে তা কুরআন স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে সন্তানদের। পিতা-মাতার মৃত্যুর আগেও পরে কীভাবে তার সঙ্গে আচরণ করবে, কীভাবে পিতা-মাতাকে বার্ধক্যে উপনীত হলে কি করবে আর কি করবে না। মৃত্যু বরণ করলে কি করবে। তাহলে আপনি কেন আপনার সন্তানকে এই উদ্দেশ্যে লালন পালন করবেন যাতে আপনি বৃদ্ধ বা বার্ধক্যে উপনীত হবেন; তখন সে আপনাকে দেখা শোনা করবে? আপনার উদ্দেশ্য ঠিক না হওয়ার কারণে আপনার সন্তান আপনি যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন বৃদ্ধা শ্রমে নিয়ে দিয়ে আসে। যদি আপনি সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন অতঃপর আপনি তাকে যে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন। দ্বীন যদি সন্তানকে প্রথমে শিক্ষা দেন তাহলে সে কখনোই পিতা-মাতাকে বৃদ্ধা শ্রমে দিয়ে আসবে না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমল ছাড়া। ১. সাদাকায়ে জারিয়া ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দুআ করতে থাকে। (মুসলিম: ১৬৩১)
শিশুর জীবনের শুরুতেই ভুল শিক্ষা দেয়া যাবে না। সর্ব প্রথম রবের পরিচয়। যে সন্তান সর্ব প্রথম রবের পরিচয় পেয়ে বেড়ে উঠবে সে কখনো দ্বীন থেকে বিচ্যুত হবে না। দ্বীন ও ধর্ম তাকে এমনিতেই সে পিতা-মাতার প্রতি অনুরাগী করে দিবে। কেননা আল্লাহ তায়ালার কুরআন তাকে সেই শিক্ষা প্রদান করবে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন,
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰی وَهۡنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡکُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡکَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۴﴾
“আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো। ফিরে আসা তো আমারই কাছে।” (সুরা লুকমান: ১৪)
একটি কথা স্মরণে রাখবেন, সন্তান আপনার রিজিকের মালিক নয়। রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তাই সব সময়ে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা রাখবেন; এবং রিজিক তাঁর কাছেই চাইবেন। সন্তানের কাছে আশা রাখবেন যেন সে আল্লাহও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। সন্তান যখন কুরআন পড়বে এবং বুঝবে। তখনই সে নিজ থেকে বুঝে যাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আদেশ করেছে পিতা-মাতা জীবিত অবস্থায় পিতা-মাতার জন্য সন্তানের দুআ করতে হবে। এবং বার্ধক্যে উপনীত হলে সেবা করবে এবং পরিচর্যা করবে। আর যদি না করে, তাহলে তার জান্নাত পাওয়ার আশা অন্ধকার হয়ে যাবে। তার দুনিয়াও আখিরাত বৃথা।
হাদিস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ‏ رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ قِيلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ‏ مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক। জিগ্যেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কে সেই ক্ষতিগ্রস্ত লোক? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে বার্ধক্যাবস্থায় পেল অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (মুসলিম:২৫৫১)
আল্লাহ তায়ালা সকল সন্তান ও পিতা-মাতাদের সঠিক দ্বীনের বুঝ দান করুক। আমিন।

মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ
নবীণ আলেম ও লেখক
কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102