জাসমিনা খাতুন, রামপুরহাট, বীরভূম, ভারত
সূর্যের শহরে, যেখানে পোড়ামাটির ছাদগুলি রক্তাভ আলোতে জ্বলজ্বল করে, সেখানে বাস করত সহজ সরল লাবণ্যময়ী এক মেয়ে, যার নাম সবিতা।
সবিতা নামের অর্থ “সূর্য”, আর তিনি যেন নিজের মাঝে সেই সূর্যের উষ্ণতাকেই বহন করতেন। গায়ে থাকত উজ্জ্বল হলুদ কামিজ, যেন সরিষা ফুলের প্রাণ।
প্রতিদিনের মতো আজও সে হেঁটে চলল কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত বাজারের পথে।
বাজারের বাতাস ছিল ভারী—ঘাম আর মাটির গন্ধ মিশে তৈরি করেছিল এক ধরনের বিষণ্ণতা, যা জেলেদের কঠোর পরিশ্রমের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল।
সবিতা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল কৃষ্ণা নদীর তীরে। সেখানে জেলেরা সারি সারি নৌকা নিয়ে তীরে ফিরছিল, মাছ ধরে।
তার চোখ পড়ল এক বৃদ্ধ মৎস্যজীবীর দিকে। তার নাম ছিল বেতাল, এবং তার মুখের ভাঁজ আর বলিরেখা যেন নদীর শতবর্ষের গল্প বলে যাচ্ছিল।
তার ত্বক ছিল রুক্ষ, যেন বুড়ো বটগাছের ছাল, মাথায় ছিল উস্কোখুসকো বাউণ্ডুলে কাশফুলের চুল।
বেতাল এক চোখে তাকিয়ে সবিতাকে প্রশ্ন করল, “মেয়ে, তুমি কি সেই সূর্যের হলুদ, যা আমাদের আলোর পথে নিয়ে যায়, নাকি সেই গোধূলির কমলা, যা সবকিছু বিবর্ণ করে দেয়..?”
সবিতা হেসে বলল, “আমি উভয়ই, তবুও কেউ নই।
আমি সেই তাপ, যা জীবনের সব সুরকে একত্র করে। সব জীবনকে প্রাণবন্ত করে তোলে।”
তারা একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়ল অল্প কিছুক্ষণের জন্য। গাছটি যেমন সুন্দর, তেমনি ভীতিকর ছমছমে ছায়া যেন অন্ধকারের প্রতিনিধি, যা সবিতার উজ্জ্বলতার বিপরীত ছিল।
বেতাল শুরু করল নদীর গল্প—জলের উপরে তিনশো মাছ সাঁতরে চলছিল, তাদের লাল আর কমলা পাখনা পানির ভাজ ভেঙে উঠছিল নামছিল তালে তালে, আর তাদের চোখ হীরার মতো ঝলমল করছিল।
এই মাছগুলো যখন কাঁদত, তখন তাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ত মূল্যবান মুক্তো, যা নক্ষত্রের স্বর্গীয় সমাবেশ তৈরি করত। প্রতিটি মাছের সাথে ছিল একটি করে গল্প।
সবিতা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, যেন সে ধীরে ধীরে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করছে।
সূর্যের আলো নদীর উপরে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নাচছিল, আর সবিতা অনুভব করছিল, যেন এই আলো পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য তার হৃদয়ের মধ্যে একত্রিত করছে।
হঠাৎ, বেতাল তার হাতে একটি ছোট নকশা কাটা পোড়ামাটির ফুলদানি তুলে দিল।
“এই খালি পাত্রে সূর্যালোক বুনে দাও,” বলল সে।
সবিতার আঙুলগুলো যেন জাদুকরের মতো নড়ে উঠল, আর সে সূর্যালোকের রং—বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, কমলা, ও লাল—বুনতে শুরু করল।
দিনের শেষে, সূর্য যখন ক্লান্ত দিগন্তের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছিল, দীর্ঘ একটা ঘুম দিতে, ঠিক তখনই সেই ফুলদানিটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন পুরো সূর্যের শহর তার মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে, এক মুহূর্তে।
বেতাল সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “তোমার হৃদয় সেই সূর্যের আলো, যা অন্ধকারকেও বদলে দিতে পারে।”
উজ্জ্বল ফুলদানিটি হাতে নিয়ে শহরে ফিরল সবিতা।
তার উষ্ণ আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, মানুষের মুখে হাসি ফুটল, আর তাদের মনে জেগে উঠল নতুন আশার স্ফুরণ।
দিন শেষে সূর্যের শহর নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু সবিতা রয়ে গেল, আলোর এক চিরন্তন বাতিঘর হিসেবে। আর যে তাকে স্পর্শ করেছে, তার জীবনেই সূর্যের আলো বুনে গেছে।