রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি;
নেত্রকোনায় এবার বোর মৌসুমে হাওরাঞ্চলসহ জেলায় বোর ধানেরবাম্পার ফলন হলেও বোর চাষিরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের অভিযোগ কষ্ট করে উৎপাদন করা ফসলের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে উৎপাদন খরচ মেলানো সম্ভব হচ্ছেনা তাদের। সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও কৃষি পণ্যের দাম বেড়েযাওয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। সরকার থেকে প্রতি কেজি ধানের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করলেও তাদের উৎপাদন খরচই উঠবে না বলে জানান বরো চাষীরা। এবার ফলন বেশী হওয়ায় স্থানীয় হাট-বাজারের ধান ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কিনছেন। ফলে কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রান্তিক চাষীরা।
নেত্রোকোনার বারহাট্টা উপজেলার গেপাপালপুর, মধ্যবাজার ও আসমা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ৯৫০-১০৫০ টাকা মন দরে মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে।
বারহাট্টা সদর ইউনিয়নের গড়মা এলাকার কৃষক তপন সরকারবলেন, ‘গিরস্তি করে কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারছি না। একমণ ধান বেঁচেও মাছ-তরকারী কিনে বাড়ি যেতে পারবো না। কিভাবে কীকরবো ভেবে পাচ্ছি না। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে সংসার চালানোই কষ্টদায়ক হয়েগেছে। সারা বছর কিভাবে চলবো,ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ কিভাবে চালিয়ে যাবো তা্ ভেবে পাচ্ছিনা’।
একই উপজেলার রায়পুর গ্রামের কৃষক রতন মিয়া ধান বিক্রি করতে এসেছেন, স্থানীয় বাজার ‘ফকিরের বাজারে’। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন শুধু শুধু পরিশ্রম করে গিরস্তি করে লাভনাই, এখন লাভের থেকে লোকসানই বেশি হয়। এখন তেলের দাম বাড়তি, বিদ্যুতের দাম বাড়তি, জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। উৎপাদন খরচের সঙ্গে ধান বিক্রি করে হিসাব মিলছে না। আমার এক মণ ধান ফলাতে সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার টাকার মত খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু বাজারে বেঁচতে গেলে দাম পাই মাত্র ৯৫০ টাকা। কিন্তু সরকার দাম দিচ্ছে ১২০০ টাকা। আমরাতো গুদামে ধান বেচতে পারি না। বেঁচতে হয় আড়ৎদারদের কাছে, তারা যত কম দাম দিয়ে কিনতে পারবে ততিই তাদের লাভ।’
হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক শহীদ মৌল্লা বলেন, ‘দাম কম হওয়া সত্ত্বেও অনেক কৃষক ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।সংসারের প্রতিদিনের খরচ যোগাতে অর্থের প্রয়োজন আবার অনেকেই ঋণ করে চাষাবাদ করেছেন।সময়মতো পাওনাদারের ঋণ পরিশোধ করতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।’
জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর নেত্রকোনায় বোরো মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমি। কিন্তু আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশী ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে অতিরিক্ত ২৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। জেলায় বোরো ফসল থেকে সম্ভাব্য ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৬৩ মেট্রিক টন।
তারা আরও জানায়, শুধুমাত্র হাওরে ৪০ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। এসব জমি থেকে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৫ মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৭৪৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদরে ধান- ১৭৩৫ মেট্রিক টন, চাল- ২৮ হাজার ৭৭ মেট্রিক টন, বারহাট্টায় ধান- ১১৯৩ মেট্রিক টন, চাল- ৫৬৭৬ মেট্রিক টন, পূর্বধলায় ধান- ১৮৪৮ মেট্রিক টন, চাল- ১৪ হাজার ৫৪৭ মেট্রিক টন, মোহনগঞ্জে ধান- ১৩৩৮ মেট্রিক টন, চাল- ৪৩৭৯ মেট্রিক টন, কেন্দুয়ায় ধান- ১৬৬৬ মেট্রিক টন, চাল- ৪২৮০ মেট্রিক টন, দুর্গাপুরে ধান- ১৫২২ মেট্রিক টন, চাল- ১৫৪ মেট্রিক টন, মদনে ধান- ১৪৭৬ মেট্রিক টন, চাল- ১০২মেট্রিক টন, আটপাড়ায় ধান- ৯৮৬ মেট্রিক টন, চাল- ১০৭৭ মেট্রিক টন, কলমাকান্দায় ধান- ১৭০৫ মেট্রিক টন, চাল- ৪৯ মেট্রিক টন ও খালিয়াজুরীতে ধান- ১৭০৮ মেট্রিক টন ও চাল- ৭৭ মেট্রিক টন ক্রয় করা হবে। জেলায় মোট ১৫ হাজার ১৭৭ মেট্রিক টন ধান ও ৬১ হাজার ২১৮ মেট্রিক টন চাল সরকার নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করা হবে।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোয়েতাছেমুর রহমান বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৩০ টাকা কেজি দরে ১৫ হাজার ১৭৭ মেট্রিক টন ধান ও ৪৪ টাকা কেজি দরে ৬১ হাজার ২১৮ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হয়েছে। কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই কৃষকরা যাতে সহজেই গুদামে ধান সরবরাহ করতেপারেন সেজন্য বাজার তদারকি করা হচ্ছে।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, গত ১৫ মে থেকে জেলায় ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। নির্ধারিত নিয়মে নিবন্ধন করে কৃষকরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারবেন।