মহ:মহসিন হাবিব
বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব ছিলেন সিরাজদৌলা। সিরাজ কে পরাজিত করে মীর জাফর আলী খাঁ, ইংরেজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলা,বিহার উড়িষ্যা দখল করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে স্বত্ব মোতাবেক ২৪ টি জংলি মহল বা ২৪ টি পরগনা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করে। এই চব্বিশটি মহল বা পরগনা পরবর্তীতে ২৪ পরগনা নামে পরিচিত হয়,স্বাধীনতার পরে এই ২৪টি পরগনা দুটি জেলাতে ভাগ হয়। ২৪পরগনার বুক চিরে অনেক নদী আছে।ইছামতি একটি আদুরে নদী। ইছামতির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মধুমাখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। এই ইছামতির তীরে অবস্থিত প্রাচীন শহর বনগাঁও,এখন বনগাঁ নামে পরিচিত।পাশ দিয়ে চলে গেছে যশোর রোড সুদূর বাংলাদেশ পর্যন্ত। রাস্তার দু’ধারে প্রাচীনতম গাছগুলি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছি। প্রকৃতির এক অপূর্ব শোভা। এলাকাবাসী এই গাছগুলোকে সযত্নে নিজ সন্তানের মতো আজও লালিত পালিত করে রেখেছে। বিভিন্ন উদ্যোগে গাছগুলোকে কেটে রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা হয়েছিল কিন্তু সেই পরিকল্পনা আজও সফল হয়নি এলাকার মানুষের জন্য।মোটের উপর বনগাঁ ও তার আশেপাশে পরিবেশ খুব শান্ত স্নিগ্ধ। এখানকার মানুষগুলো খুব সুন্দর। মিলেমিশে থাকার মতই এরকমই একটি পরিবার ইছামতির তীরে বাস করে। বাংলা ভাগের বহু আগে থেকেই এই পরিবারটি বাস করে এই শহরে।বাংলা ভাগের সময় ওপার থেকে প্রচুর মানুষ এসেছিলো গৃহহারা, আত্মীয় হারা, ভূমিহারা হয়ে,কাঁটাতারের বেড়া বিদ্ধ করেছিল এপার বাংলা ওপার বাংলার প্রচুর মানুষকে। এই বনগাঁ শহরেই বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস চারিদিকে। পেটের তাগিদে প্রচুর উদ্বাস্তু…কেও চায়ের দোকান,ট্রেনে হকারি, কুলির কাজ আরও কত কাজে তারা ব্যস্ত থাকে।
হিন্দু পাড়ার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস, মুসলিম পাড়ার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস এখানে।কিন্তু মোটের উপর নিজেদের মধ্যে একটা অটুট মেল বন্ধন ।দুর্গাপুজোর আনন্দে মেতে ওঠে রহিম জব্বার সালাম ওরা। ঠিক তেমনি ঈদের খুশিতে মেতে ওঠে পূজা, কমল,স্বপন, বেবি,মোহিনী সকলেই। এই শহরের এক প্রান্তে বাস করত খান সাহেব আলী। আলী সাহেবের পূর্বপুরুষ এখানেই বাস করতো।হত-দরিদ্র অবস্থা, খুবই কষ্টে কাটতো আলীর জীবন।চার সন্তান ও দুই মেয়ে, আলী কাজ করত লোহার দোকানে এবং তার স্ত্রী ফাতেমা সেলাই এর কাজ পাড়ায় পাড়ায় সকলকে দিত এবং নিজেও সেলাই করত সেই সেলাইয়ের কাজ নিয়ে ট্রেনে করে যেত অনেকটা দূরে গুমা নামক একটি স্থানে, সামান্য কয়েকটা পয়সা পেতো সেই পয়সা নিয়ে এসে প্রতিদিনকার বাজার হতো। ওদিকে আলীর লোহার কাজ করতে খুবই কষ্ট হতো, লোহা টেনে টেনে হাতে এবং কাঁধে দাগ পড়ে গেছিল।তার সংগ্রামী সংসার জীবন শহরের বুকে এক ইতিহাস।শহরের পরিবেশে চারটি সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া তার সাথে খাওয়ানো, পরানো, মাখানো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সামান্য লোহার দোকানে কাজ আর ফাতেমার সেলাইয়ের কাজে কোন রকমে ও চলেনা। তাদের এমনকি মাথা গোঁজার ও ঠাঁই ছিল না। পাশের এক সহৃদয় ব্যক্তির সহানুভূতিতে ঠাঁই পেয়েছিল একটি ছোট্ট চালা ঘরে,তখন তার বড় ছেলে বাচ্চু জন্মগ্রহণ করে।বাচ্চু কে নিয়ে আলী ও ফাতেমার জীবন কষ্টে হলেও আনন্দে কাটে। দুপুরে খাওয়া শেষে দুজনে পান খেতো মনের আনন্দে। স্বামী ও স্ত্রী র এই অপূর্ব মিল ও বন্ধন কোনো লেখকের কলমে ধরা পড়বে না।বছর যতই যায় আলীর সংসারে সদস্য ততোই বাড়ে।জীবনের চিন্তা ও ততই বাড়ে। দুধ হরলিকস তো দূরের কথা তিন বেলা ফ্যান ভাত আর নুন জোগানো…খুব কষ্টে পরিণত হলো আলীর।এরপরএই শিশুদের পড়াশুনো ।প্রাণপণ চেষ্টা করে আলী,সেই লোহার দোকানে বাড়তি টাকা ইনকামের জন্য এক্সটা কাজ করে। কয়েক বছর কাজ করার পর তার শরীরে ধরা পড়লো এক কঠিন ব্যাধি। সেই কঠিন ব্যাধি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। অল্প পয়সা নিয়ে আলী কলকাতায় যায়, সেখানে ডাক্তারেরা বলে, কঠিন অসুখ। ওষুধ খায়, একটু ভালো হয়। কিছুদিন পরে আবার একই অবস্থা।সেদিন গেলো ডাক্তার দেখাতে, ডাক্তার বলল উপায় নেই… হঠাৎ একদিন পরিবারের সকলকে ফাঁকি দিয়ে পাড়ি দিলো দূর অজানার দেশে। সংসারে নেমে এলো এক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলীর বড়ো ছেলে বাচ্চু তখন কলেজে পড়ে।সংসারের দায়িত্ব নিতে বাচ্চু নিজের লেখাপড়াকে বিসর্জন দিল… ফাতেমার সংসারের হাল ধরতে বাড়ির বড় ছেলে বাচ্চু নিজেকে বিলিয়ে দেয় কষ্টের সাগরে। ওইটুকু ছেলে সেই সাইকেল নিয়ে উলের ব্যবসা শুরু করে, উলের ব্যবসা করতে দূর দূর গ্রামে যেত। বিক্রি করে সেই বিক্রির টাকায় সংসারের বাজার,ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খাতা কেনা, টিউশনির মাইনে…সব যোগান দিত। ভাই-বোনদের শখ, এমনি করেই চলে তাদের সংগ্রামী জীবন।এই সংগ্রামী জীবনে ক্লান্ত হয়ে পড়েনি বাচ্চু, গল্পের সংগ্রামী নায়ক বাচ্চু আর গল্পের নায়িকা মা ফাতেমা দুজনে মিলে সংসারের হাল শক্ত করে ধরে।তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তার মেজ ভাই তারও লেখাপড়া বেশি দূর হয়ে ওঠেনি,হাতের কাজ সে জানতো সে বাড়িতেই একটি ছোট কারখানা করে,সেখান থেকেও কিছু উৎপাদন হত। সেজ ভাই পড়াশোনায় মেধাবী ছিল পড়াশোনা সে অনেক দূর এগিয়ে চলে। ছোট বোন সেও পড়াশোনায় ভালো ছিল দুই ভাইবোনে পড়াশুনোর সাথে সাথেই সংসারের হাল ধরতে টিউশনি করে ।এই বাড়ির প্রত্যেকেই অর্থ উপার্জন করে সংসার অতিবাহিত করে।শহরের বুকে সংসার চালানো বড় দায়।
বাচ্চুর বড় বোনের বিয়ের ঠিক হয় এক স্কুল মাস্টারের সঙ্গে দেনা পাওনা সেইরকম খুব একটা লাগেনি তবুও বিয়ের সামগ্রী জোগাড় করতে প্রত্যেকেই হিমশিম খেয়ে ওঠে।এমনি করেই তারা তার বড় বোনের বিয়ে সমাধান করে। দেখতে দেখতে বাচ্চুর চল্লিশের চৌকাঠ পেরোবার সময়,বয়স অনেকটা হয়ে গেল, মা ফাতেমা স্থির করে বাচ্চুর বিয়ে দেবে।এক ঘটকের সন্ধানে মেয়ে খুঁজে পেলো। একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে কৃষ্ণনগরে বাড়ি।দেখাশোনা হওয়ার সাথে সাথেই উভয়ের পছন্দ হয়ে গেল।দেরি না করে ফাতেমা বড়ো খোকার বিয়ে ঠিক করলো। এই বিয়ের কোনো আর্থিক জৌলুস ছিলনা। তবে মন ভরা ভালবাসা ছিল । নতুন বৌ এই বাড়ীতে সকলের নয়নের মণি …বউ মনি হয়ে উঠলো। বড় সাধ ছিল আলীর বড় ছেলের বিয়ে দেবে ,বউমা আনবে ঘরে, কিন্তু সে সাধ তার পূরণ হয়নি। অভাবের সংসারে নতুন স্থায়ী তিথি এলো।সকলের প্রিয় সেই বউ মনিকে নিয়ে বাচ্চু তার ভাই-বোন বেশ সুখেই জীবন কাটাতে লাগে। বিয়ের পরের বছর সংসারে খুব অভাব।সংসারের চাপ বাড়তে থাকে,একদিকে বেকার ভাইয়ের জ্বালা আর একদিকে বিবাহযোগ্যা বোন।ওদিকে মেজো ভাই একটি সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ করে।
এমনি করেই চলতে চলতে বাচ্চুদের বাড়িতে আলো করে এলো এক ফুটফুটে চাঁদ শিশু। জোছনার আলোর মত শিশুর শখ করে নাম রাখল সানি। ফাতিমা বলে আমার আলী আবার এসেছে আমার দ্বারে।সানিকে নিয়ে বাড়ির সকলে দারুণ উন্মাদনা, সারাদিনে সকলের দুঃখে কাটলেও সানির কে নিয়ে তাদের বেশ সুখেই কাটে।
উলের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বাচ্চু এখন কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে, কাপড়ের ব্যবসা হাটে হাটে গিয়ে কাপড় বিক্রি করা বেশ কিছু লাভ হতে থাকে ।বরাবর বাচ্চুর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও মনটা ছিল বড়ই উদার।বাড়িতে কেও এলে বাচ্চুর বাজার করার বহর দেখার মতো! খাওন দাওনের ত্রুটি ছিল না।বাজারে গেলে সব থেকে বড় মাছ, বড় মুরগি, খাসির মাংস ইত্যাদি বোঝাই করে বাজার আনতো বাড়িতে। কিছুদিন পরে ই বাচ্চুর এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হলো সেই কন্যা সন্তান এতটাই মিষ্টি মধুর শখ করে সবাই নাম রাখলো মিঠি। বাচ্চু বলে আমার আর একটা মা!
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়… হয়তো এই সত্যিটা খান সাহেবের পরিবারেও ঘটলো। এই বছরটা খান পরিবারের জীবনে সবথেকে মধুরতম বছর। দুই ভাই বোন একসাথে ওই বছরে সরকারি চাকরি পেল। এ যেন বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টি ,মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ,বাঁধনহারা আনন্দ আকাশের চাঁদ মাটির পৃথিবীতে ধরা দিল। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে এই কথাটি যুগ যুগ ধরে সত্যি হয়ে আসে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে। এতদিনে মা ফাতেমার কষ্ট লাঘব হলো। বাচ্চুর জীবনে আর কোন দুঃখ নেই,কষ্ট নেই। এখন শুধু সুখ আর সুখ এক অনাবিল আনন্দের ছায়া বিরাজ করে ইছামতির তীরে এই খান পরিবারে। পূর্ণিমার চাঁদ ধরা দিয়েছে ইছামতির তীরে খান পরিবারের এই সংসারে। চার ভাই এবং দুই বোন সকলেই তাদের মা ফাতেমাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে কাটাই তাদের বাকি জীবন। (এই গল্পের সাথে কাকতালীয়ভাবে যদি কারোর নিজের জীবনে বা নিজের সংসারে বা কারো চেনা সংসারের জীবনে মিলে যায় তার জন্য লেখক দায়ী নয়, এটি গল্প লেখক এর কল্পনার ভাবনা মাত্র)